ছাতিমতলার গান - সুব্রত সেন মজুমদার Chatimatalar Gaan by Subroto Sen

ছাতিমতলার গান - সুব্রত সেন মজুমদার Chatimatalar Gaan by Subroto Sen

ছাতিমতলার গান - সুব্রত সেন মজুমদার Chatimatalar Gaan by Subroto Sen
বই – ছাতিমতলার গান
লেখক – সুব্রত সেন মজুমদার
প্রকাশক – সিগনেট প্রেস
প্রচ্ছদ – নন্দলাল বসু
প্রথম প্রকাশ – এপ্রিল ২০১৬
পৃষ্ঠা সংখ্যা – ২৩৬
মুদ্রিত মূল্য – ₹২৫০/-​


“ আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন।
তার আকাশ-ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে,
মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন॥ “
– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিংশ শতাব্দীর সূচনায় কবিগুরু পূর্ববঙ্গ থেকে দেশে ফিরলেন। কিন্তু কলকাতায় জোড়াসাঁকোতে ফিরতে তাঁর মন চাইল না। তাই তিনি বীরভূমের রাঙামাটির সোঁদা গন্ধে ভরা বোলপুরের কাছে ভুবনডাঙ্গাতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের চলে গেলেন বসবাস করার জন্য। কুড়ি বিঘা জমির মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ “শান্তিনিকেতন” নাম দিয়ে এক বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। কবিগুরু সেখানেই থাকতে শুরু করলেন। পরীক্ষা ব্যবস্থা সহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যা কবিকে বরাবরই বড় বিব্রত করত। তিনি দেশের আগামী প্রজন্মকে প্রাকৃতিক পরিবেশে মুক্ত বিদ্যালয়ে নিজেদের ইচ্ছা মত ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও বিদ্যার্জনে পারদর্শী করে তোলার উদ্দেশ্যে পাঁচজন ছাত্র ও পাঁচজন শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে শান্তিনিকেতনেই গড়ে তুললেন এক আশ্রমিক বিদ্যালয়, নাম দিলেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা ব্রহ্মবিদ্যালয়। পরবর্তীকালে ছাত্রদের সাথে সাথে যোগ দিলেন ছাত্রীরাও। যে চারাগাছ রোপণে কবিকে বিপুল সামাজিক ও আর্থিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা দিনে দিনে মহীরুহে পরিণত হয়ে দেশের গণ্ডী পার হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বিদেশেও।

কবিগুরু লিখেছেন -

“মোদের তরুমূলের মেলা, মোদের খোলা মাঠের খেলা,
মোদের নীল গগনের সোহাগ-মাখা সকাল-সন্ধ্যাবেলা।
মোদের শালের ছায়াবীথি বাজায় বনের কলগীতি,
সদাই পাতার নাচে মেতে আছে আম্‌লকী-কানন॥“


কবি রচিত এই আশ্রম সঙ্গীতের শব্দগুচ্ছের কল্পনাই বাস্তবে ধরা পড়েছে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক বিদ্যাপ্রাঙ্গনে। আশ্রমিক বিদ্যালয়ের মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে গাছের তলায় বেদীতে শ্রেণীকক্ষ, ছাতা মাথায় করেও পড়াশোনা করা, খেলাধুলা, সারা বছর ধরে বিভিন্ন উৎসব পালনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা, সাহিত্য চর্চার সাথে সাথে আলোচনা, নাটক – এই সব ঘিরেই গড়ে উঠেছিল শান্তিনিকেতন মহাবিদ্যালয়। সাথে ছিল অফুরন্ত দুরন্তপনা ও প্রশ্রয়। লেখক সুব্রত সেন মজুমদারের পিতা ১৯৫২ -৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। সেই সূত্রেই সপরিবারে সেখানে থাকতে যাওয়া এবং বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। পরবর্তীকালে লেখকের জীবন যেন এক রাবীন্দ্রিক কাব্যগাথায় রচিত উপন্যাস। বহু গুনীজনের সংস্পর্শে আসা, তাঁদের আশীর্বাদধন্য হওয়া ছিল এক পরম প্রাপ্তি। সেই যুগের শান্তিনিকেতনের দূষণমুক্ত সবুজ প্রকৃতি, মানুষের সহজ সরল ব্যবহার, জটিলতাহীন উচ্চাশার পিছনে না ছুটে চলা অতি সাধারণ কিন্তু আনন্দময় পরিবেশের কথা লেখক বলেছেন এই বইয়ে।



পঞ্চাশের দশকে সারা দেশে শান্তিনিকেতন সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থান রূপে পরিচিতি লাভ করেছিল। দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকেই শুধু নয় বিদেশ থেকেও ছাত্র- ছাত্রী এবং শিক্ষকরা আসতেন প্রাকৃতিক পরিবেশে বিদ্যা ও জ্ঞান অর্জনের জন্য। এক আঙিনায় একসাথে বহু গুণীজনের সমাবেশ ঘটত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। লেখক নিজে বহু বিদগ্ধ ও বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন। জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী,লালবাহাদুর শাস্ত্রী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, পদ্মজা নাইডু, বিনোবা ভাবে, রবিশংকর থেকে শুরু করে মার্টিন লুথার কিং এর সাথেও সাক্ষাৎ হয়েছে। নিজের সই বইয়ে সযত্নে এঁদের সই সংগ্রহ করেছেন। গুরুপল্লীতে বসবাসের সময় ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, পূর্ণিমা ঠাকুর, ক্ষিতিমোহন সেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, নীলিমা সেন প্রমুখ গুণীজনকে পেয়েছেন প্রতিবেশীরূপে। সেই সমস্ত সুখ স্মৃতি প্রতি পাতায় ব্যক্ত করেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে।

সকাল থেকে রাত অবধি সুরেলা আশ্রমিক পরিবেশে শৈশবের দুরন্তপনা দিন থেকে শুরু করে জীবনের বাকী দিনের স্মৃতি চারণার এক অসাধারণ ও অনবদ্য দলিল অত্যন্ত সুন্দর ও সুললিত ভাবে বর্ণনা করেছেন এই বইয়ে। গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে প্রতি ছত্রে। গুরুদেবের মৃত্যুর পরেও তাই তাঁকে নিজেদের আশেপাশে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কখনও অতিশয়ক্তি করেন নি। বরং প্রাঞ্জলভাবে ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে শান্তিনিকেতনকে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। এই বই শুধু পড়ার নয়। অনুভব করার, উপলব্ধি করা। এই বই বাংলার এমন এক সময় এমন এক স্থানকে বর্ণনা করে যা পাঠককে বহুদিন এক মানসিক শান্তিতে ভরে রাখে। পাঠক অনায়াসে ছুঁয়ে আসেন কোপাইয়ের বিস্তৃত নদীচর। রঙিন হয়ে ওঠেন শাল – শিমূল – পলাশ- কৃষ্ণচুড়ার রঙে। সুবাসে মুগ্ধ হন আম – কাঁঠাল- তাল – জলপাই – আমলকীর গা ছুঁয়ে ভেসে আসা বাতাসে। মনে মনে হারিয়ে যান আম্রকুঞ্জের ঘন ছায়ায়। বই শেষ হয়ে যায়, গভীর রেশ রয়ে যায় মনে, হয়ত জীবনেও।

রিভিউটি লিখেছেনঃ Sanjhbati

Post a Comment

0 Comments