নববর্ষ শুরু হলেই সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি বোধহয় একটু বেশি মাত্রায় রবীন্দ্রমুখী হয়ে পড়েন। অন্তত আমি সেরকমই হয়ে যাই। ছোটবেলায় এই সময় থেকেই আসন্ন রবীন্দ্র জয়ন্তীর উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হওয়াই হয়ত এর মূল কারণ। দিন বদলের সাথে সাথে সেসব এখন শুধুই স্মৃতি, কিন্তু প্রবণতাটা এখনও রয়ে গেছে। তাই এই সময় প্রতি বছরই আমি সেই আগের মতই কবিগুরুকে আঁকড়ে ধরি। তারই ফল স্বরূপ একগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত পড়াশোনা শুরু হয়। বা গান সিনেমা নাচ এইসব দেখে মত্ত থাকি।
বই – শ্রীসদনের শ্রীমতীরা
লেখিকা – ঋতা বসু
প্রকাশনী – আনন্দ পাবলিশার্স
প্রথম প্রকাশ – ডিসেম্বর ২০১৬
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ – ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য – ₹ ১৫০-/
পৃষ্ঠা – ১৫০
বোলপুর শান্তিনিকেতন। নামের সাথেই জড়িয়ে আছে এক মায়াময় কবিত্বে ভরা রাবীন্দ্রিক আবেশ। নাম উচ্চারণের সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে ওঠে শিমূল পলাশের ছায়ায় ঢাকা লালমাটি কাঁকরের আঁকা বাঁকা রাস্তা, ছাতিমতলা, আশ্রমের পরিবেশ, হস্তশিল্পের বিপুল সমাহার। কানে বেজে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পবিত্র সুর, কবিতার বাণী, নৃত্যের নূপুর ধ্বনি। তার সাথেই মনে পড়ে যায় কবিগুরুর স্বহস্তে নির্মিত বহু পরিশ্রমের ফসল শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক বিদ্যাঙ্গন। দুর – দুরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসতেন। হোস্টেলে থাকতেন। ছাত্রদের ও ছাত্রীদের পৃথক হোস্টেল। ছাত্রীনিবাসের নাম ছিল শ্রীভবন। যা পরে পরিবর্তিত হয়ে “শ্রীসদন” হয়ে যায়।
লেখিকা ঋতা বসু একদিন বাড়িমুখী বাসের অভাবে হেদুয়া থেকে হেঁটে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে যাবার আনন্দকে নিত্যদিনের ঘটনায় পর্যবসিত করে ফেলার কারণে শাস্তিস্বরূপ মাত্র নয় বছর বয়সে শান্তিনিকেতনের ছাত্রীনিবাসে পদার্পণ করেন। চৌষট্টি সালের পুজোর পরে এক বিকালে এক ভাই ও এক বোনকে সঙ্গী করে তাঁর হোস্টেল জীবন শুরু হয়। বাড়ি থেকে চলে আসার দুঃখে যখন অন্যরা কান্নাকাটিতে মগ্ন, তখন বন্ধনহীন স্বাধীনতা পেয়ে এবং একা রোজ একটা গোটা ডিম খেতে পাবার আনন্দে উদ্বেল লেখিকা সারা আশ্রম চত্বর অভিযানে ব্যস্ত হয়ে পরেন এবং দুর্ঘটনা থেকে কোনোমতে বেঁচে ফেরেন। পরবর্তী কয়েক বছরের আশ্রম জীবন ধরেই চলে তাঁর বা তাঁদের বিভিন্ন ধরণের দস্যিপনার ধারাবাহিকতা।
উনিশ শতকের সূচনালগ্নে বিশ্বকবি ভুবনডাঙ্গার সজীব বনানীর আলয়ে মায়াময় আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাতে ছাত্রজীবন বন্ধনহীন উন্মুক্ত হয়। সজীব প্রকৃতির কোলে শৈশব ও কৈশোর যেন শাসনের বেড়াজাল মুক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় পূর্ণরূপে বিকশিত হতে পারে। তথাকথিত বিদ্যা প্রাঙ্গনের বিধি নিষেধ – পরীক্ষা পদ্ধতিতে যেন কোমলমতি প্রাণদের অকালে বার্ধক্যে পৌঁছে না দেয়। তাঁরা যেন নিজেদের খেয়ালখুশিতে বিদ্যার্জন করতে সক্ষম হয়। গুরুদেবের এই মহৎ উদ্দেশ্যকে আশ্রমিকরা প্রতি পদে স্মরণ ক’রে বা বলা ভালো নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার ক’রে, লেখাপড়া শিকেয় তুলে বাকি সমস্ত (অ)কাজে বেশি মনযোগী হয়ে পড়তেন। সেই সমস্ত কার্যাবলীর নিপুণ ও নিখুঁত বর্ণনাই লেখিকা অত্যন্ত সরসভাবে অনাবিল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।
প্রত্যন্ত বাংলার এক আশ্রমে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের ছাত্রছাত্রীরা যখন পড়তে আসতেন তখন ইংরাজির তুলনায় বাংলা ভাষা অধিকমাত্রায় ব্যবহৃত হবার ফলে এবং সুযোগ্য ইংরাজি ভাষার শিক্ষকের অভাবে আশ্রমিকরা আর কিছু না হোক নিঃসন্দেহে বাংলায় অত্যন্ত দক্ষতা লাভ করতেন। লেখিকার বয়ানে পাওয়া যায় বিদেশীদের উত্তরায়ণের রাস্তা ইংরাজিতে বুঝিয়ে বলতে অসুবিধা হওয়ায় জনৈকা ছাত্রী সংক্ষেপে “ফলো মি” বলে একদল বিদেশীকে নিজের পিছু ধাওয়া করিয়েছিলেন। কিংবা বিদেশী ইংরাজির শিক্ষক ইংরাজি শেখাতে এসে নিজেই বাংলায় পারদর্শী হয়ে দেশে ফিরে গেছিলেন।
যে যুগে নারী শিক্ষাই ছিল এক যুগান্তকারী বিপ্লব সেখানে শান্তিনিকেতনে ছাত্রী নিবাস তৈরি করা সহজ ছিল না। নিন্দেমন্দ থেকে শুরু করে আর্থিক বিপর্যয় অবধি বহুবিধ সামাজিক বাধার সম্মুখীন কবিগুরুকে হতে হয়েছিল। কিন্তু নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে যে ছাত্রীনিবাস তিনি গড়ে তুলেছিলেন; পরবর্তীকালে সেইখানে তাঁর সেই উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণ রূপদান করেছিলেন বঙ্গ তথা ভারতীয় নারীরা। ছাত্রদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিক্ষা – সংস্কৃতিতে অবদান রাখার সাথে সাথে দামালপনাতেও তাঁরা কিছু কম যাননি। তা সে পড়ায় ফাঁকিবাজিতেই হোক, তুখোড় দোকানদারীতেই হোক কিংবা প্রেমের আরোহণ – অবরোহণেই হোক না কেন। প্রেম করতে গিয়ে কবিতা লেখা থেকে শুরু করে একজনের প্রেমে ভাগ বসানোই হোক কিংবা প্রেমে ধরা পড়ে গিয়ে বন্ধুদের শাস্তি মকুবের দাবীতে ধর্নায় বসে ইতিহাস রচনা করাতেই হোক। পিছিয়ে ছিলেন না কিছুতেই।
বড় মন কাড়া সেইসব বর্ণনা। বাড়ি থেকে আগত নতুনদের আশ্রমের কঠোর নিয়মানুবর্তীতা শেখানোর সাথে সাথেই থাকত আদর ও স্নেহের আঁচলের আশ্রয়ও। আশ্রমের বড় দিদিরাই আপন হয়ে ‘মোগলাই অন্দরমহলে’র মতই মেয়ে হোস্টেলের যাবতীয় কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা শিখিয়ে দিতে এগিয়ে আসতেন। শুধু যে নিয়ম শেখাতেন তাই-ই নয় সাথে শেখাতেন নিয়মভাঙ্গাও। নিয়মিত বাড়িতে চিঠি লেখা ছিল বাধ্যতামূলক। এবং কার সংগ্রহে কত বেশি প্রত্যুত্তর থাকত তার প্রতিযোগিতাও চলত নীরবে।
শাড়ির বদলে মোরব্বা কেনা, সবাই মিলে একসাথে নববর্ষের কার্ড বানানো, ছাত্র হোস্টেলে নির্জন দুপুরে নিঃসঙ্কোচে ও নির্ভয়ে হানা দিয়ে মেলার জন্য আঁকা যোগাড় করা, হস্টেল পালিয়ে দুষ্টুমি কিংবা ‘পরপুরুষ ফুচকাওয়ালা’র সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া এবং সে জন্য পরিশীলিত ও সুতীব্র বাণী বর্ষণে শাস্তি নীরবে গ্রহণ করা, সদ্য প্রেমিক যুগলকে লুকিয়ে ভয় দেখানো বা সদ্য প্রেমিককে মিথ্যা বলে ভুল পথে চালিত করা, বাৎসরিক পিকনিকে একসাথে একবছরের খিদে নিবারণ এবং সাথে সাথেই অতিরিক্ত খাদ্যাভার গাছের আড়ালে বিসর্জন করে হালকা হওয়াসহ অসংখ্য স্মৃতিমেদুর ঘটনা। এবং এই সব কিছুর সাথে সাথেই শান্তিনিকেতনের বারো মাসে তেরো পার্বণ পালনের মহোৎসব। প্রতিটি উৎসব যাপন এক এক প্রকারের অনুভূতিতে সিক্ত। যেমন ছিল বসন্তোৎসবে পলাশ ফুলের মালায় সেজে গায়ে আবীর মেখে ছাত্র ছাত্রী নির্বিশেষে আরক্ত আনন্দোল্লাস; তেমনি ছিল নববর্ষ ও মহালয়াতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজেদের পারদর্শীতার মধুর প্রকাশ।
ছাত্রীনিবাস বাসিনীরা "মেয়েরা শান্তই হয়" - এই বাক্যবন্ধকে রীতিমত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে এক একজন স্বমহিমায় অবলীলাক্রমে দামালপনার শীর্ষ ছাপিয়ে গেছেন। যে কোনও পরিস্থিতিতে কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে ঢালরূপে ব্যবহার করা যায় তারও উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি ছোট থেকে বড় কেউই। কিন্তু এত কিছুর পরেও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কবিগুরুর ভাবাদর্শকে কালিমালিপ্ত করেননি। বরং তা যে সত্যিই কত দূরদর্শিতার পরিচায়ক ছিল তাই প্রমাণ করেছেন।
কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়ে যেত প্রতিদিনকার ঘণ্টাধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে প্রার্থনায়, দুষ্টুমি ও ধরাপড়ায়, পক্স বা চোখ ওঠার মত রোগে গণ অসুস্থ হয়ে একই ঘরে আড্ডার সমাহারে ও সুস্থদের আপ্রাণ অসুস্থ হওয়ার চেষ্টা করায়, ফাঁকিবাজি ও পড়াশোনায়, স্টাডি আওয়ার থেকে পালিয়ে ছাদের রোদে বসে উকুন বাছায়, জন্মদিন পালনে নমস্কার প্রদানে, ঝগড়া ও আলিঙ্গনে, বিনা অনুমতিতে অন্যের খাবারে ভাগ বসানোয়, আড়ি ও ভাবে, প্রেমে ও বিচ্ছেদ-বিরহে, বাল্যখিল্যপনায় ও গেছোমিতে, নাচে – গানে – কবিতা ও গল্পে, সুখে ও দুঃখে, নিয়মে ও বেনিয়মে, বাংলায় পাণ্ডিত্যে ও ইংরাজিকে এড়িয়ে চলার মধ্য দিয়েই। মাত্র নয় বছরেই নিজের মশারী ভাঁজ করার মত দুরূহ কাজ শিখে ফেলা কিংবা নিত্য পরিপাটি করে ‘ন্যাতানো শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ক্লাস করতে যাওয়া’র মাধ্যমেই তাঁরা চটজলদি বিচক্ষণ নারী হয়ে উঠতেন। জীবনের সেই দৈনন্দিনতায় রবীন্দ্রনাথের দর্শনের ভিত এমনভাবে গাঁথা হয়ে যেত যে ব্যক্তিত্বের ভিতও গড়ে উঠতে বিশেষ অসুবিধা হত না। তাই যারা শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের ‘বিশ্বনিন্দিত’ ন্যাকামির বর্ণনায় গরুকে ফুলের ডাল দিয়ে মারার কথা উল্লেখ করতেন তাঁদের ভুল শুধরে দিয়ে “না, ডালের বাড়িতে গরু বড় ব্যাথা পায়, তাই আজকাল আমরা ফুলের রেণু দিয়ে আঘাত করি” – বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করতেন না।
ছাত্রী নিবাসের প্রথম দিন থেকে শেষদিন অবধি সময়কালকে ‘প্রাককথন’, ‘প্রথম আলোর পরশখানি’, ‘চিঠি’, ‘লেখাপড়া’, ‘শ্রীসদনের জন্মবৃত্তান্ত’ প্রভৃতি ছোট ছোট অনুচ্ছেদে রচনা করেছেন। আশ্রমবাসের প্রতি মুহূর্ত কবিগুরুকে জড়িয়ে নিয়ে দিন কাটানোর মুহূর্তগুলিতে “ক্ষণিকা”-সঙ্গিনী ছাত্রীর দল নিজেরাও বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যে নিজেদের দৃপ্ত - বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাখতে শুরু করে দিতেন নিজেদের অজান্তেই। এখানেই কবিগুরুর আশ্রম প্রতিষ্ঠার সার্থকতা। লেখিকা ঋতা বসুর অনাবিল হাস্যরসপূর্ণ লেখার সাথে ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের নন্দলাল বসুর ঘরানায় আঁকা অলংকরণ প্রতিটি পাঠকের মন ভালোলাগা ও শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ করে দেবে একথা বলাই বাহুল্য। কবিগুরুর লেখা “জীবনস্মৃতি” পড়তে পড়তে যেমন আমরা মুগ্ধ হই, ঠিক তেমনিই এই বই পড়তে পড়তেও কবিগুরুর আশ্রমের অলিন্দে – বাগিচায় – প্রার্থনা কক্ষে বিলীন হতে থাকি। ছাত্রীদের আশ্রমের পাঠপর্ব শেষ হলে ভারাক্রান্ত মনে তাঁরা বিদায় নেন, বই শেষ হলে আমারও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন বড় তাড়াতাড়ি আমারও হোস্টেলবাস শেষ হয়ে গেল। আমিও যেন চন্দনা – পাপিয়া – মালতী – সুনন্দা – সুদেষ্ণা – তপতীদের ছেড়ে বন্ধুহীন হয়ে গেলাম। যেন বিদায় নিলাম মিষ্টুনীদি, পূর্ণিমা সুধাদি, অমাবস্যা সুধাদিদের কাছ থেকে। কিন্তু তবুও এক মধুর রেশ রয়ে গেল। এবার বাড়ি ফেরার পালা। লেখিকার কণ্ঠ যেন কানে কানে বলে উঠল –
লেখিকা ঋতা বসু একদিন বাড়িমুখী বাসের অভাবে হেদুয়া থেকে হেঁটে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে যাবার আনন্দকে নিত্যদিনের ঘটনায় পর্যবসিত করে ফেলার কারণে শাস্তিস্বরূপ মাত্র নয় বছর বয়সে শান্তিনিকেতনের ছাত্রীনিবাসে পদার্পণ করেন। চৌষট্টি সালের পুজোর পরে এক বিকালে এক ভাই ও এক বোনকে সঙ্গী করে তাঁর হোস্টেল জীবন শুরু হয়। বাড়ি থেকে চলে আসার দুঃখে যখন অন্যরা কান্নাকাটিতে মগ্ন, তখন বন্ধনহীন স্বাধীনতা পেয়ে এবং একা রোজ একটা গোটা ডিম খেতে পাবার আনন্দে উদ্বেল লেখিকা সারা আশ্রম চত্বর অভিযানে ব্যস্ত হয়ে পরেন এবং দুর্ঘটনা থেকে কোনোমতে বেঁচে ফেরেন। পরবর্তী কয়েক বছরের আশ্রম জীবন ধরেই চলে তাঁর বা তাঁদের বিভিন্ন ধরণের দস্যিপনার ধারাবাহিকতা।
উনিশ শতকের সূচনালগ্নে বিশ্বকবি ভুবনডাঙ্গার সজীব বনানীর আলয়ে মায়াময় আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাতে ছাত্রজীবন বন্ধনহীন উন্মুক্ত হয়। সজীব প্রকৃতির কোলে শৈশব ও কৈশোর যেন শাসনের বেড়াজাল মুক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় পূর্ণরূপে বিকশিত হতে পারে। তথাকথিত বিদ্যা প্রাঙ্গনের বিধি নিষেধ – পরীক্ষা পদ্ধতিতে যেন কোমলমতি প্রাণদের অকালে বার্ধক্যে পৌঁছে না দেয়। তাঁরা যেন নিজেদের খেয়ালখুশিতে বিদ্যার্জন করতে সক্ষম হয়। গুরুদেবের এই মহৎ উদ্দেশ্যকে আশ্রমিকরা প্রতি পদে স্মরণ ক’রে বা বলা ভালো নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার ক’রে, লেখাপড়া শিকেয় তুলে বাকি সমস্ত (অ)কাজে বেশি মনযোগী হয়ে পড়তেন। সেই সমস্ত কার্যাবলীর নিপুণ ও নিখুঁত বর্ণনাই লেখিকা অত্যন্ত সরসভাবে অনাবিল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।
প্রত্যন্ত বাংলার এক আশ্রমে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের ছাত্রছাত্রীরা যখন পড়তে আসতেন তখন ইংরাজির তুলনায় বাংলা ভাষা অধিকমাত্রায় ব্যবহৃত হবার ফলে এবং সুযোগ্য ইংরাজি ভাষার শিক্ষকের অভাবে আশ্রমিকরা আর কিছু না হোক নিঃসন্দেহে বাংলায় অত্যন্ত দক্ষতা লাভ করতেন। লেখিকার বয়ানে পাওয়া যায় বিদেশীদের উত্তরায়ণের রাস্তা ইংরাজিতে বুঝিয়ে বলতে অসুবিধা হওয়ায় জনৈকা ছাত্রী সংক্ষেপে “ফলো মি” বলে একদল বিদেশীকে নিজের পিছু ধাওয়া করিয়েছিলেন। কিংবা বিদেশী ইংরাজির শিক্ষক ইংরাজি শেখাতে এসে নিজেই বাংলায় পারদর্শী হয়ে দেশে ফিরে গেছিলেন।
যে যুগে নারী শিক্ষাই ছিল এক যুগান্তকারী বিপ্লব সেখানে শান্তিনিকেতনে ছাত্রী নিবাস তৈরি করা সহজ ছিল না। নিন্দেমন্দ থেকে শুরু করে আর্থিক বিপর্যয় অবধি বহুবিধ সামাজিক বাধার সম্মুখীন কবিগুরুকে হতে হয়েছিল। কিন্তু নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে যে ছাত্রীনিবাস তিনি গড়ে তুলেছিলেন; পরবর্তীকালে সেইখানে তাঁর সেই উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণ রূপদান করেছিলেন বঙ্গ তথা ভারতীয় নারীরা। ছাত্রদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিক্ষা – সংস্কৃতিতে অবদান রাখার সাথে সাথে দামালপনাতেও তাঁরা কিছু কম যাননি। তা সে পড়ায় ফাঁকিবাজিতেই হোক, তুখোড় দোকানদারীতেই হোক কিংবা প্রেমের আরোহণ – অবরোহণেই হোক না কেন। প্রেম করতে গিয়ে কবিতা লেখা থেকে শুরু করে একজনের প্রেমে ভাগ বসানোই হোক কিংবা প্রেমে ধরা পড়ে গিয়ে বন্ধুদের শাস্তি মকুবের দাবীতে ধর্নায় বসে ইতিহাস রচনা করাতেই হোক। পিছিয়ে ছিলেন না কিছুতেই।
বড় মন কাড়া সেইসব বর্ণনা। বাড়ি থেকে আগত নতুনদের আশ্রমের কঠোর নিয়মানুবর্তীতা শেখানোর সাথে সাথেই থাকত আদর ও স্নেহের আঁচলের আশ্রয়ও। আশ্রমের বড় দিদিরাই আপন হয়ে ‘মোগলাই অন্দরমহলে’র মতই মেয়ে হোস্টেলের যাবতীয় কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা শিখিয়ে দিতে এগিয়ে আসতেন। শুধু যে নিয়ম শেখাতেন তাই-ই নয় সাথে শেখাতেন নিয়মভাঙ্গাও। নিয়মিত বাড়িতে চিঠি লেখা ছিল বাধ্যতামূলক। এবং কার সংগ্রহে কত বেশি প্রত্যুত্তর থাকত তার প্রতিযোগিতাও চলত নীরবে।
শাড়ির বদলে মোরব্বা কেনা, সবাই মিলে একসাথে নববর্ষের কার্ড বানানো, ছাত্র হোস্টেলে নির্জন দুপুরে নিঃসঙ্কোচে ও নির্ভয়ে হানা দিয়ে মেলার জন্য আঁকা যোগাড় করা, হস্টেল পালিয়ে দুষ্টুমি কিংবা ‘পরপুরুষ ফুচকাওয়ালা’র সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া এবং সে জন্য পরিশীলিত ও সুতীব্র বাণী বর্ষণে শাস্তি নীরবে গ্রহণ করা, সদ্য প্রেমিক যুগলকে লুকিয়ে ভয় দেখানো বা সদ্য প্রেমিককে মিথ্যা বলে ভুল পথে চালিত করা, বাৎসরিক পিকনিকে একসাথে একবছরের খিদে নিবারণ এবং সাথে সাথেই অতিরিক্ত খাদ্যাভার গাছের আড়ালে বিসর্জন করে হালকা হওয়াসহ অসংখ্য স্মৃতিমেদুর ঘটনা। এবং এই সব কিছুর সাথে সাথেই শান্তিনিকেতনের বারো মাসে তেরো পার্বণ পালনের মহোৎসব। প্রতিটি উৎসব যাপন এক এক প্রকারের অনুভূতিতে সিক্ত। যেমন ছিল বসন্তোৎসবে পলাশ ফুলের মালায় সেজে গায়ে আবীর মেখে ছাত্র ছাত্রী নির্বিশেষে আরক্ত আনন্দোল্লাস; তেমনি ছিল নববর্ষ ও মহালয়াতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজেদের পারদর্শীতার মধুর প্রকাশ।
ছাত্রীনিবাস বাসিনীরা "মেয়েরা শান্তই হয়" - এই বাক্যবন্ধকে রীতিমত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে এক একজন স্বমহিমায় অবলীলাক্রমে দামালপনার শীর্ষ ছাপিয়ে গেছেন। যে কোনও পরিস্থিতিতে কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে ঢালরূপে ব্যবহার করা যায় তারও উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি ছোট থেকে বড় কেউই। কিন্তু এত কিছুর পরেও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কবিগুরুর ভাবাদর্শকে কালিমালিপ্ত করেননি। বরং তা যে সত্যিই কত দূরদর্শিতার পরিচায়ক ছিল তাই প্রমাণ করেছেন।
কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়ে যেত প্রতিদিনকার ঘণ্টাধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে প্রার্থনায়, দুষ্টুমি ও ধরাপড়ায়, পক্স বা চোখ ওঠার মত রোগে গণ অসুস্থ হয়ে একই ঘরে আড্ডার সমাহারে ও সুস্থদের আপ্রাণ অসুস্থ হওয়ার চেষ্টা করায়, ফাঁকিবাজি ও পড়াশোনায়, স্টাডি আওয়ার থেকে পালিয়ে ছাদের রোদে বসে উকুন বাছায়, জন্মদিন পালনে নমস্কার প্রদানে, ঝগড়া ও আলিঙ্গনে, বিনা অনুমতিতে অন্যের খাবারে ভাগ বসানোয়, আড়ি ও ভাবে, প্রেমে ও বিচ্ছেদ-বিরহে, বাল্যখিল্যপনায় ও গেছোমিতে, নাচে – গানে – কবিতা ও গল্পে, সুখে ও দুঃখে, নিয়মে ও বেনিয়মে, বাংলায় পাণ্ডিত্যে ও ইংরাজিকে এড়িয়ে চলার মধ্য দিয়েই। মাত্র নয় বছরেই নিজের মশারী ভাঁজ করার মত দুরূহ কাজ শিখে ফেলা কিংবা নিত্য পরিপাটি করে ‘ন্যাতানো শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ক্লাস করতে যাওয়া’র মাধ্যমেই তাঁরা চটজলদি বিচক্ষণ নারী হয়ে উঠতেন। জীবনের সেই দৈনন্দিনতায় রবীন্দ্রনাথের দর্শনের ভিত এমনভাবে গাঁথা হয়ে যেত যে ব্যক্তিত্বের ভিতও গড়ে উঠতে বিশেষ অসুবিধা হত না। তাই যারা শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের ‘বিশ্বনিন্দিত’ ন্যাকামির বর্ণনায় গরুকে ফুলের ডাল দিয়ে মারার কথা উল্লেখ করতেন তাঁদের ভুল শুধরে দিয়ে “না, ডালের বাড়িতে গরু বড় ব্যাথা পায়, তাই আজকাল আমরা ফুলের রেণু দিয়ে আঘাত করি” – বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করতেন না।
ছাত্রী নিবাসের প্রথম দিন থেকে শেষদিন অবধি সময়কালকে ‘প্রাককথন’, ‘প্রথম আলোর পরশখানি’, ‘চিঠি’, ‘লেখাপড়া’, ‘শ্রীসদনের জন্মবৃত্তান্ত’ প্রভৃতি ছোট ছোট অনুচ্ছেদে রচনা করেছেন। আশ্রমবাসের প্রতি মুহূর্ত কবিগুরুকে জড়িয়ে নিয়ে দিন কাটানোর মুহূর্তগুলিতে “ক্ষণিকা”-সঙ্গিনী ছাত্রীর দল নিজেরাও বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যে নিজেদের দৃপ্ত - বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাখতে শুরু করে দিতেন নিজেদের অজান্তেই। এখানেই কবিগুরুর আশ্রম প্রতিষ্ঠার সার্থকতা। লেখিকা ঋতা বসুর অনাবিল হাস্যরসপূর্ণ লেখার সাথে ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের নন্দলাল বসুর ঘরানায় আঁকা অলংকরণ প্রতিটি পাঠকের মন ভালোলাগা ও শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ করে দেবে একথা বলাই বাহুল্য। কবিগুরুর লেখা “জীবনস্মৃতি” পড়তে পড়তে যেমন আমরা মুগ্ধ হই, ঠিক তেমনিই এই বই পড়তে পড়তেও কবিগুরুর আশ্রমের অলিন্দে – বাগিচায় – প্রার্থনা কক্ষে বিলীন হতে থাকি। ছাত্রীদের আশ্রমের পাঠপর্ব শেষ হলে ভারাক্রান্ত মনে তাঁরা বিদায় নেন, বই শেষ হলে আমারও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন বড় তাড়াতাড়ি আমারও হোস্টেলবাস শেষ হয়ে গেল। আমিও যেন চন্দনা – পাপিয়া – মালতী – সুনন্দা – সুদেষ্ণা – তপতীদের ছেড়ে বন্ধুহীন হয়ে গেলাম। যেন বিদায় নিলাম মিষ্টুনীদি, পূর্ণিমা সুধাদি, অমাবস্যা সুধাদিদের কাছ থেকে। কিন্তু তবুও এক মধুর রেশ রয়ে গেল। এবার বাড়ি ফেরার পালা। লেখিকার কণ্ঠ যেন কানে কানে বলে উঠল –
জোনাকি তার পাখায় পেল।
ক্ষণকালের ছন্দ
উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল
সেই তার আনন্দ।
ক্ষণকালের ছন্দ
উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল
সেই তার আনন্দ।
ভালো থাকুন। বইকে ভালো বাসুন।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Sanjhbati
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।