শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় Srikrishner Sesh Kota Din - Sanjib Chattopadhyay Review

শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় Srikrishner Sesh Kota Din - Sanjib Chattopadhyay Review

বই – শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন
লেখক – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশনী – আনন্দ
পৃষ্ঠাসংখ্যা – ১০৪
প্রকাশকাল: এপ্রিল ২০১৬
প্রচ্ছদঃ ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় সাধারণত তীব্র ব্যাঙ্গাত্মক, তির্যক কিন্তু হাস্যরসে ভরপুর লেখার জন্য সুবিখ্যাত। তীক্ষ্ণ রসবোধ,সঙ্গে তীব্র শ্লেষ মেশানো হাস্যরস ঘরানার লেখকদের মধ্যে প্রথম সারিতে অবশ্যই তিনি স্থান অধিকার করেন।হাস্যরসাত্মক লেখার মাধ্যমে তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক বহু বিষয়কে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভঙ্গিমায় লিখে পাঠকদের মনোরঞ্জন করে আসছেন বহু বছর ধরেই।

তাঁর এই নিজস্ব ঘরানার বাইরে বেড়িয়ে ছক ভাঙ্গেন খুব সম্ভবত “ লোটাকম্বল” উপন্যাসের মাধ্যমে। এই উপন্যাস সাধারণ পাঠকমহলে এবং একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞ সমালোচক মহলেও সমান জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা অর্জন করে। তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠককূলের সাথে সাথে সাহিত্য বিদগ্ধমহলও হয়ত এই বইয়ের জন্য তাঁর অ্যাকাডেমী পুরস্কার লাভের আশা করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা পাননি। পরবর্তীকালে 'শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন' বইটির জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

১৪২১ বঙ্গাব্দে শারদীয়া বর্তমানে 'শেষ কটা দিন' নাম দিয়ে এই উপন্যাসের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরে সেই লেখাটিই পরিমার্জনে 'শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন' নামে বইয়ের আকারে প্রকাশ পায় এবং সাহিত্য অ্যাকাডেমী পুরস্কার লাভ করে।

বইয়ের বিষয়ে বলতে শুরু করলে প্রথমেই যেটা বলা দরকার তা হল, বইয়ের বিষয়ের সাথে বইয়ের নামকরনের খুব একটা সামঞ্জস্য রক্ষা হয়নি। নাম দেখে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হয় যে, এই বইয়ে শ্রীকৃষ্ণ জীবনের শেষ কটি দিন কি চিন্তা ভাবনা করেছিলেন বা কিভাবে তিনি শেষ দিনগুলি অতিবাহিত করেছিলেন, হয়ত সেই বিষয়ে লেখা। কিন্তু তা নয়। এই বই সমগ্র মহাভারতের মুখ্য ঘটনাপ্রবাহের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধত্তোরকালে সম্পূর্ণ মহাভারতের প্রতিটি ঘটনার বিশ্লেষন করা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টিতে। যেখানে ভক্ত প্রশ্ন করেছেন ভগবানকে আর উত্তরও যেন নিজের থেকেই প্রাপ্ত হচ্ছেন। সমগ্র মহাভারতের সমস্ত ঘটনার কার্য কারণের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি চরিত্রের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি, তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া বিশেষ ঘটনাগুলির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয়েছে। যদুবংশের ধ্বংস ও শ্রীকৃষ্ণর মৃত্যুর বিবরণ দিয়ে বই শেষ হয়েছে।


মুখবন্ধ

শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী তুমি নারায়ণ, তুমি কৃষ্ণ, তুমি করুণাসিন্ধু। মর্ত্য-লীলাশেষ। এইবার বুঝি বিদায় নেওয়ার পালা। এসেছিলেন কংসের কারাগারে। নিষ্ঠুর রক্তাক্ত এই পৃথিবীতে রেখে গেলেন ‘প্রেম যমুনা’। শ্রীমতী তো আপনারই হ্লাদিনী শক্তি। চাঁদের যেমন কিরণ। কোথা বৃন্দাবন, কোথা গোপীগণ, কোথা কৃষ্ণ! এ তো আমাদের ক্রন্দন। আপনার তো কিছু নয়। নিজেই গড়লেন, নিজেই ভাঙলেন। কিন্তু, যাবেন কোথায় প্রভু! ভক্তদের বন্ধন! সমুদ্রের তটেই চির অবস্থান – প্রভু জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম। শ্রীকৃষ্ণ ভগবান।​


মানবরূপী বিষ্ণুবতার শ্রীকৃষ্ণকে জানার আগ্রহ যুগ যুগ ধরে। বহু লেখক – বিশেষজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক বহু বই – কাব্য রচনা করেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। এই বইটিও সেই রকমই একটি রচনা। ভক্ত ও ভগবানের কথোপকথন রূপে বইটি রচিত।

বইয়ের মূল শিক্ষণীয় বিষয় হল —

আমাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনা পূর্বনির্ধারিত এবং প্রতিটি ঘটনার কারণও যুক্তিপূর্ণ এবং আমাদেরই কর্মফলের প্রতিফলন।

অর্থাৎ আমরা যা করব তারই ফল ভোগ করব। কৃষ্ণমতে কর্মফল শুধুমাত্র এই জন্মেরই নয়, পূর্বজন্মেরও ফল, যা আমাদের পরবর্তী জন্মে ভোগ করতে হয়। সমগ্র মহাভারতে জন্মান্তরবাদের বিভিন্ন ঘটনা আমরা দেখতে পাই। যেমন দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী প্রাপ্তি। তাঁর পূর্ব জন্মের তপস্যার ফল পরবর্তী জন্মে পান্ডবদের স্বামীরূপে পাওয়া।যেমন ভীষ্ম হত্যায় শিখণ্ডীর ভুমিকা। যা কিনা পূর্বজন্মের অম্বার বরপ্রাপ্তি। একই ভাবে কৃষ্ণের মৃত্যুর কারণ স্বরূপ গান্ধারীর অভিশাপের উল্লেখ আছে। বলা হচ্ছে —
গান্ধারী বললেন, " গোবিন্দ! যেহেতু পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত জ্ঞাতি কৌরব ও পাণ্ডবগণকে তুমি উপেক্ষা করেছ, সেই কারণে তুমিও নিজের জ্ঞাতি-বান্ধবদের বিনাশ করবে।"

এর উত্তরে কৃষ্ণ মৃদু হাসছেন ও বলছেন , " ক্ষত্রিয়ে ! জানি, আমি সব জানি, এই রকমই হবে। তুমি নতুন কিছু বললে না।….. "​

শ্রীকৃষ্ণ ত্রিকালদর্শী ছিলেন। ইচ্ছাবলে ইহকালের সমস্ত ঘটনা প্রবাহের দিক নির্ধারিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শুধু সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ সঠিক দিশায় সঞ্চালন করে গেছেন। সম্ভবত জানাতে চেয়েছেন নিয়তিকে পাল্টানোর ক্ষমতা হয়ত কারো নেই। বা কর্মফলের ভোগ সকলকে করতেই হয়। তা অপরিবর্তনশীল। পরিবর্তন করা উচিত না। আত্মার জন্ম নেই। যার জন্ম নেই তাঁর মৃত্যুও সম্ভব নয়। তাই আত্মা অজেয়, অপক্ষয়হীন, বৃদ্ধিশূন্য। কিন্তু শরীরের অস্তিত্ব আছে, শরীর পিঞ্জরসম। এর ক্ষয় আছে, জরা, ব্যাধি, মৃত্যুও আছে।ব্যাখ্যা যাই হোক যার শুরু আছে তারই শেষ আছে,উদয় হলে অস্তও অনিবার্য কিন্তু তা চক্রবৎ। এরই মধ্যে এক শক্তি বিরাজমান। যা এই সকলকে নিয়ন্ত্রিত করছে। তিনিই আর কেউ নন, স্বয়ং রথারূঢ় বাসুদেব। তাঁর সহজ রূপটি মধুরতম। কিন্তু বিশ্বরূপ কেমন?

“ দিবি সূর্য-সহস্রস্য ভবেদ যুগপদুত্থিতা।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ ॥ ১২॥ “

অর্থাৎ যদি আকাশে সহস্র সূর্যের প্রভা যুগপৎ উদিত হয়, তা হলে সেই মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভার কিঞ্চিৎ তুল্য হতে পারে।

কৃষ্ণ এক মহারহস্য, অজানা – অপরিজ্ঞাত সৃষ্টি রহস্য, লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধকাল। যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে বিনাশ করতে পরেন, অথচ পরাভূত হলেন কালের কাছে। নিজের আত্মীয়, পরিজন, পরিবার কারো বিনাশ রোধ করলেন না।রোধ করলেন না রক্তক্ষয়ী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে। রোধ করলেন না বিনাশকারী পাশাখেলাকে, রোধ করলেন না দ্রৌপদীর চরম হেনস্থা কিন্তু রক্ষা করলেন তাঁর নারীত্বকে, রোধ করলেন না অভিমন্যু বধকে।নত মস্তকে মেনে নিলেন নিয়তিকে।তাই হয়ত জীবনের শেষদিন একাকী লোকচক্ষুর আড়ালে সামান্য এক ব্যাধের তীরের আঘাতে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে নিজের জীবনকে দিলেন চরম অবহেলাময় এক সমাপ্তি।এটাই তাঁর কর্মফল। 

রিভিউটি লিখেছেনঃ Sanjhbati

Post a Comment

0 Comments