হাওয়ার মতন, নেশার মতন - সন্মাত্রানন্দ Hawar Moton Neshar Moton by Sanmatrananda

হাওয়ার মতন, নেশার মতন - সন্মাত্রানন্দ Hawar Moton Neshar Moton by Sanmatrananda

হাওয়ার মতন, নেশার মতন 
সন্মাত্রানন্দ
প্রকাশক ধানসিডি 
মুদ্রিত মূল্য-275/-

অনেকেই বলেন বাংলা সাহিত্য মধ্যমেধার প্রাবল্যে ভুগছে। সম্পূর্ণ একমত না হলেও পেইড রিভিউ, পুশ সেল, প্রতিটি বইয়ের 'বেস্টসেলার তকমা পাওয়া অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মূল উপজীব্য শহরে মধ্যবিত্তের পরকীয়া, তন্ত্রের নামে বিকৃত যৌনাচারের বিবরণ, কিংবা গোটা তিন চারেক দিশি- বিলিতি গোয়েন্দা কাহিনীর সংমিশ্রণে সংকর প্রজাতি থ্রিলার অভিযোগের বাস্তবতাকে মানতে ধানিক বাধ্য করে। এই অবস্থায় আমার পথসঙ্গী যখন গাঁটের কড়ি খরচ করে আনকোরা নতুন হাওয়ার মতন, নেশার মতন উপহার দিলেন, যারপরনাই আশঙ্কিত হয়েছিলাম। কারণ, উপহারের সমালোচনা একপ্রকার দাতার রুচির দিকে আঙুল তোলা, অথচ পাঠিকা আমি-টি বড় দুর্মুখ।
না, উপরোক্ত অভিযোগগুলি লেখকের ক্ষেত্রে যে খাটে না, সে তাঁর পরম নিন্দুকও স্বীকার করবেন। এক্ষেত্রে ভয়ের কারণ ছিল অন্য। তাঁর সবথেকে জনপ্রিয় বই- নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা পড়ে লেখনীর ততখানি। সমাদর করতে পারিনি, বরং লেখনী তার মাধুর্য নিয়ে আমার কাছে ধরা দিয়েছিল ছায়াচরাচর, তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি এবং ভামতী- অশ্রুমতী-তে। কিন্তু যিনি পলায় পায়সান্ন রন্ধনে সুপটু, তিনি যদি হঠাৎ বলেন বড়ি দিয়ে নিরামিষ চচ্চড়ি রাখবেন তাহলে চিন্তা হয়। সব রান্না কি সবাই পারে? সব যন্ত্র কি সবার হাতে প্রাণ পায়, সাড়া জাগাতে পারে শ্রোতার অন্তরের অদৃশ্য বীণায়?
তাই প্রাজ্ঞ দার্শনিক যদি আমার-আপনার মতো মানুষের আজকের দিন-কালকের রাতের গল্প লেখেন, যারা নিয়মমাফিক এসে ভেসে যায়, বিশেষ কোনো ফলবতী চমক আনে না, টুকরো ভালো লাগা, ক্ষণিক হৃদয়ে দোলা লাগিয়ে টুপ করে মিলিয়ে যেতে থাকে, অথবা কখনো স্বপ্ন উপকূলে ফিরে আসে আধো নিদ্রায় তখন ভয় থাকে। সব মোহ-মায়া বলে চরম ঔদাস্যে উড়িয়ে দেওয়ার ভয়, অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে অসারতা নির্ণয়ের ভয়ে, কিছু না হোক, অপাত্রে দর্শন শাস্ত্রের জ্ঞান উপদেশের ভয়।
আমাদের জীবন অসংখ্য অজস্র আকস্মিক, অভাবিতের নিয়মহারা সমাহার, ভালো-মন্দ, সুখ-দু:খের বাইনারিতে তাকে ধরা যায় না। মূহূর্ত তৈরী হয়, সম্ভাবনা আসে বা যায়, তাদের মতো করে। আমাদের জীবন তার এই অপরিণতি, অপূর্ণতা জেনেও কল্পনায় হোক বা বাস্তবে গড়ে তুলতে চায় ক্রমানুবর্তী, পরিণতিপ্রাপ্ত কাহিনী। আমাদের পূর্বরাগের পরিণতি অনুরাগে, প্রণয়ের পরিণতি বিবাহে বিবাহের পরিণতি সন্তানে- এই পরিচিত পরিণতিকামিতার ছককে কোমল অথচ দৃঢ়তায় প্রশ্ন করেছে উপন্যাসটি। বারেবারে।
উপন্যাসটি হতে পারত অরণ্য-তাপ্তীর সার্থক প্রেমাখ্যান, কিংবা হতে পারত অরণ্যের মানবচরিত্র অন্বেষণের, বা ব্রতীন্দ্রনাথ-র প্রাবতীর উপাখ্যান। কিন্তু না, এ তেমন নয়। এ মূহূর্ত কখন। এ এক অনুভব। এক যাত্রা। কেমন যাত্রা? তা জানেন শুধু পাঠক।
সংবাদপত্রে সাপ্তাহিক পর্বে যখন প্রকাশিত হয়ে চলেছিল, তখন কয়েক পর্বের পর আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিলাম, জানিনা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রূপে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে কীনা, তবে বর্তমান অনুভব- সাপ্তাহিক ব্যবধান এ রচনার রসাস্বাদনে পরিপন্থী। এ সৃষ্টি সোহিনী রাগের মতো, শ্রীমতীর মতো বিরহমূর্তি। শেষ পৃষ্ঠা থেকে বন্ধ মলাটের মাঝে দীর্ঘক্ষণ পাঠককে ঘিরে থাকবে এক অপূর্ব সুগন্ধির অবশেষ, এবং হয়তো, আরো দীর্ঘকাল অন্তরে থাকবে সে গন্ধ, সে আবেশ। হয়তো সে আবেশে আমরাও হররোজ আল্লাতালার জাদুতে মুগ্ধ হব, পরিণতিকামিতা আরো একটু দূরে সরে সরে হয়তো অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।

রিভিউটি লিখেছেনঃ Tridhara

Post a Comment

0 Comments