চন্দ্রদ্বীপের গুপ্তধন রাজা ভট্টাচার্য
শারদীয়া শুকতারা ১৪২৯
একটি চমৎকার কিশোর পাঠ্য উপযোগী রহস্য উপন্যাস। বড়দেরও পড়তে বেশ লাগবে। প্রথাগত পরিচিত রহস্য লেখকদের নামের বাইরে অপরিচিত নাম, কিন্তু লেখার স্বাদ অনবদ্য।
ষোড়শ শতাব্দীর বাংলাদেশ। সমতট অঞ্চলে চন্দ্রদীপ নামক একটি ছোট রাজ্য। সমৃদ্ধ গঙ্গাবেষ্টিত মধ্যযুগের সেই সময়কালের ইতিহাসের স্বাক্ষর। যে পর্বে বাঙালি বণিকেরা দেশে-বিদেশে নিজেদের সাহস শ্রম বৈভব ও সমৃদ্ধির ধারাবাহিক ইতিহাস গড়ে তুলছিল। বাণিজ্যজাত সমৃদ্ধি দিয়ে ঘেরা এই ছোট্ট সুখী নিরাপদ রাজ্যে এলো এক আকস্মিক বিপর্যয়। কুল-আচার্যের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী তদানীন্তন হিন্দু রাজা জগদানন্দ রায়ের সাধনার সিদ্ধি লাভ হবে। আর ঠিক সাত দিন বাদে স্বয়ং মা গঙ্গা নিজে এসে তাঁকে দেখা দেবেন। কিন্তু তার পরিণামে সমগ্র রাজ্যে আসবে মহা দুর্যোগ, প্রলয়। সাময়িকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে সমৃদ্ধ জনপদ। রাজা জগদানন্দ মন্ত্রী মুকুন্দ কুলপুরোহিত বাসুদেব আচার্য মিলে এই পরিস্থিতিতে গোপনে নিলেন অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত। রাজ পরিবারের বিপুল সম্পদ ভাগ করে তিন রাজপুত্রের মাধ্যমে তাদের পরিবারসহ ছড়িয়ে দিলেন তিন দিকে। প্রধান ভাগ নিয়ে জ্যেষ্ঠ যুবরাজকে সপরিবারে রাখা হলো খুব গোপন নিরাপদ স্থানে। কেননা তারই উপর প্রধান দায়িত্ব বিপর্যয়ের পর ফিরে এসে নতুন করে এই সমতটকে চন্দ্রদীপ রাজ্যকে পুনর্গঠনের। মধ্যমকে বঙ্গদেশের দূরবর্তী অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এবং সর্বকনিষ্ঠ কিশোর পুত্রকে বিশ্বস্ত অনুচর সহযোগে পাঠানো হলো সুদূর সুবর্ণভূমিতে। সেখানকার কিছু ঘনিষ্ঠ স্থানীয় বণিকদের শুভাকাঙ্ক্ষী জনেদের নিরাপদ বেষ্টনের মধ্যে। উদ্দেশ্য একটিই, যদি কোন এক পুত্র ফিরে আসতে বিফল হয় বাকি কারোর না কারোর দ্বারা সেই বংশের রাজ কর্তব্যের পরম্পরা বহাল থাকবে। অবশেষে এলো বিপর্যয়। রাজা মন্ত্রী পুরোহিত এবং রাজ পরিবারের বাইরে কেউই জানতেন না এই আসন্ন প্রলয়ের কথা। কেননা এই প্রলয় থেকে মাত্র সাত দিনে গোটা রাজ্য ও প্রজাদের সুরক্ষার কোন পথ রাজ পরিবারের জানা ছিল না। তাই তাঁরা শুধু দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রলয় অন্তে অবশেষকে নিয়ে নতুন করে জনপদ গড়ে তোলার, ভবিষ্যৎ দায়িত্বকে সুরক্ষিত করার। অতঃপর এলো প্রলয় যার আধুনিক নাম সুনামি। বিধ্বংসী বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে গেল সমতট, জলমগ্ন হলো প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি। রাজা ও তাঁর বিশ্বস্ত দুই অনুচরের সলিলসমাধি ঘটলো।
অতঃপর ৪৫০ বছর ইতিহাসের সময় গড়িয়ে গেল। ২১ শতাব্দীর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের এক অভিজাত ঐতিহ্যবাহী ধনী পরিবার, যারা তাদের অতীত ইতিহাস জানে, ব্যবসায় সমৃদ্ধ পরিবারটির এক সন্তান ইতিহাসবিদ। চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশের একটি শাখার ধারক তারা। অন্য শাখাটি ফিরে গিয়েছিল সমতটে, যা আধুনিক বরিশাল। কিন্তু কনিষ্ঠ শাখাটির কোন হদিস মেলেনি। ইতিহাসবিদ শুভব্রতের ভাগ্নে অরিত্র এবং তার দুই কলেজ পড়ুয়া বন্ধু আর্য ও ঋতম নেমন্তন্ন খেতে আসে অরিত্রের মামাবাড়ি। তাদেঁর পরিবারের ইতিহাস ঐতিহ্যের গল্প শোনায় শুভব্রত। বন্ধুর মামার বাড়ি ইতিহাস ঐতিহ্যের গল্পে আর মিউজিয়াম সদৃশ বাড়ির মধ্যে জড়িয়ে থাকা সুপ্রাচীন ঐতিহ্যতে তারা মুগ্ধ হয়। আকস্মিকভাবে বাড়ির পুরনো অংশে সেইদিনই তারা খোঁজ পায় এক চতুর্মুখ ব্রহ্মার মূর্তির, যার দক্ষিণ মুখের রং সোনালী। ব্রহ্মার চার হাতের মধ্যে একটি হাতে থাকা বেদের ভাঁজে লুকানো এক পুরনো তালপাতার চিরকুট, যাতে ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদের আদলে লেখা একটি সংকেত সূত্র। যেন তার মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় কোন এক গুপ্তধনের। আশ্চর্য ভাবে একই সময় সেই বাড়িতে হানা দেয় এক জোড়া আগন্তুক। তাদের একজন সুদীর্ঘ ও অপর জন অত্যন্ত বেঁটে মানুষ। অতঃপর সেই ভূর্জপত্রের সূত্র ধরে তিন বন্ধু ও শুভ মামা রওনা হন সুদূর শ্যামদেশে। বা আধুনিক থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। সেখানে মামার বন্ধু আদিত্য কর্মরত। তাদের সঙ্গে ধাওয়া করে হাজির হয় সেই লম্বা বেঁটের জুড়ি।
তারপর? ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে বলে কথিত আছে। ৪৫০ বছর পরে সেই পুনরাবৃত্তির ইতিহাসে কি ঘটলো? এই সন্ধানী অভিযানে অতীতের শিকড় সন্ধানী মানুষগুলি কি সত্যিই শিকড়ে ফিরতে পারল? গুপ্তধনের ইঙ্গিতপূর্ণ ধাঁধার কি সমাধান মিললো? সে গুপ্তধনের প্রকৃত তাৎপর্য কি? কোথায় আছে সে রত্ন ভান্ডার? কিভাবে কালচক্রের পরিক্রমণের শেষে শুধু কি রত্নভান্ডার মিলবে? নাকি হারিয়ে যাওয়া অতীতের সঙ্গে ঘটবে অভূতপূর্ব পুনর্মিলন? আর পুনরাবৃত্তি কি শুধু বংশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ঘটে? প্রাকৃতিক ইতিহাসেরও কি পুনরাবৃত্তি হয় না? আর অনুসরণকারী সেই অদ্ভুত জুড়ি? তাদের অন্তরালীন রহস্যের গল্পটির বা তাদের পরিণাম? না, সবটা ভাঙা যাবে না। গল্পের সর্বশেষটি তো একেবারেই নয়। রহস্য পাঠের শেষ কয়েকটা পাতার কথা বলে দিলে তো রহস্যের মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়।
এ গল্পে কোনো গোয়েন্দা নেই, আছে আমার আপনার মতোই কিছু সাধারণ মানুষ। বন্ধুত্ব অথবা স্নেহ সম্পর্কের ভিত্তিতে কাছাকাছি আসা কিছু মানুষ। একালের মানুষ হলেও তাদের হাতে সারাক্ষণ মোবাইল, ইউ টিউব, ভিডিও গেম নিয়ে ব্যস্ততা নেই। বরঞ্চ ইতিহাস অতীত ঐতিহ্য নিয়ে তাদের আগ্রহ আছে, মানুষের কাছাকাছি এসে গল্প শোনার প্রতি ভালোবাসা আছে। আর সেই সূত্র ধরেই তাদের অভিযান, যার থেকে প্রাপ্তি ঘটে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতার, যার সারমর্ম এ গল্প।
সকলকে অনুরোধ, গল্পটি পড়বেন। পরিচিত লেখক বৃত্তের বাইরে এ গল্প। কিন্তু সকলের ভালো লাগবে।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Dhruba Mandal
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।