সৌবল শকুনি - সুচেতনা সেন কুমার Soubal Shokuni by Suchetana Sen Kumar

সৌবল শকুনি - সুচেতনা সেন কুমার Soubal Shokuni by Suchetana Sen Kumar

বইয়ের নাম - সৌবল শকুনি
লেখক - সুচেতনা সেন কুমার
প্রকালনী - একলব্য প্রকাশন
"কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধরূপ মহারণনদীর ভীষ্ম ও দ্রোণ নদীর দুই তীর, জয়দ্রথ নদীর জল, কর্ণ সেই নদীর বেলাভূমি, শল্য হাঙর স্বরূপ, অশ্বত্থামা বিকর্ণাদি কৌরব ভ্রাতাগণ কুমীর তুল্য, দূর্যোধন রণনদীর ভয়ঙ্কর আবর্ত এবং শকুনি এই রণনদীতে প্রস্ফুটিত নীলপদ্ম।"

- না। এই কথাটা আমার নয়, এই কথা লেখিকারও নয়। এই কথা স্বয়ং ব্যাসদেবের। ব্যাসদেবের প্রখর মেধা আরেক মেধাবী রাজনীতিবিদকে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি। তাই তিনি কৌরবদের সর্বশ্রেষ্ঠ মস্তিস্ক শকুনিকে তুলনা করেছেন নদীতে ফুটে থাকা নিস্কলুষ এক ইন্দিবরের মতো।

এবার আসি এই উপন্যাসের শকুনির চরিত্র অঙ্কন -

➤ শকুনি বললেই আমাদের মনে এক নাতিদীর্ঘ, কুটিল, পাপী মুখ ভেসে ওঠে মানস চরিত্রে। মাননীয় লেখিকা সুচেতনা সেন কুমার তার সৌবল শকুনি উপন্যাসে এই ধারণাটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তার 'সৌবল শকুনি' উপন্যাসে।
   শকুনি এখানে কোনো কুটিল বলিরেখা পড়ে কুঁচকে থাকা ঘৃণ্য মুখের মালিক নয়। তিনি স্বদেশপ্রেমী, দক্ষ তীরন্দাজ, অসাধারণ অশ্বারোহী সর্বোপরি স্নেহশীল দাদা, পিতা ও ভাইদের মৃত্যুতে শোকাতুর কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণেচ্ছু একজন পুত্র।
➤ Once is happenstance, twise is co incidence, thrice is enemy action - James Bond
       সারা মহাভারত জুড়ে শকুনির চরিত্রটিই এরকম যে তাঁর কার্যক্রম দেখলে তাঁকে অত্যন্ত কুশলী রাজনীতিবিদ মনে হয়। সে শুধুমাত্র দু একটা বড়ো স্টেপ আর বাকিসময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাটারফ্লাই এফেক্ট দিয়ে ধ্বংস করেছে অমিত শক্তিশালী কুরুবংশকে। হয়তো ভুল বললাম। শুধুই কি কুরুবংশ? নাকি আপামর ভারত জুড়ে চলা এক অন্তঃসারশূন্য সমাজব্যাবস্থাকে?

এহেন কল্পনাতীত বুদ্ধিমান শকুনির আপাত দৃষ্টিতে উপেক্ষাযোগ্য কিছু কার্যক্রম, শকুনির জীবনধারা, তাঁর বিচারবুদ্ধি এককথায় গান্ধারনরেশ শকুনির ভিউ পয়েন্ট থেকে যদি মহাভারতকে দেখতে চান তবে এই বইটি অবশ্যপাঠ্য।

আমার ভালোলাগা —
১. গান্ধারীর শত পুত্রের জন্ম, অম্বার থেকে শিখন্ডীর জন্ম, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ থেকে পাশাখেলায় অজস্র শেয়ালের উপস্থিতি সবেরই বাস্তবসম্মত ও লৌকিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
২. শকুনির পান্ডু, কুন্তী ও অন্যান্য পান্ডবদের প্রতি গোপন মমতাবোধ।
৩. মহাভারতের প্রায় উপেক্ষিত চরিত্র পান্ডুর উজ্জ্বল চরিত্র অঙ্কন।
৪. কুরুরাজ্য - শকুনির চিরকালীন দ্বন্দ্ব। যেখানে ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যলোলুপতা ও চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, ভীষ্মের অন্ধ বংশগৌরব আর কুরুসৈন্যদের নিষ্ঠুরতার বিপক্ষে গিয়ে অস্ত্রহীন কিন্তু বুদ্ধিমান শকুনির উদ্দেশ্য যেনতেন প্রকারে অত্যাচারী কুরুরাষ্ট্রের ধ্বংসসাধন করে এক ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠা; যেখানে হবে না কোনো নারীর অপমান, যেখানে আস্ফালন করবে না ক্ষমতার উলঙ্গ অসি, যেখানে বাহুবলের ওপরে বিজয়ী হবে হৃদয়বল।
৫. পাণ্ডবদের জন্ম, রঙ্গমঞ্চে অস্ত্রশিক্ষা প্রর্দশন করে পাণ্ডবদের বাহুবলেরর প্রকাশ, যুধিষ্ঠিরের যৌবরাজ্যাভিষেক, পাণ্ডবদের বারণাবতে প্রেরণ, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর, পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ লাভ ও রাজসূয় যজ্ঞের মাধ্যমে কুরু-পাণ্ডবের চিরস্থায়ী বৈরিতার সূত্রপাত, দ্যূতসভা, পাণ্ডবদের বনবাস ও অজ্ঞাতবাস এবং পরিশেষে অষ্টাদশ দিবস ব্যাপী কুরুক্ষেত্রের মহাসংগ্ৰাম। সব ঘটনাকে চেনা ছকের বাইরে লেখিকার বলার ইচ্ছেকে খুব ভালো লেগেছে।
৬. নকুল ও শকুনির অদ্ভুত এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বন্ধুত্ব? নাকি আরও বেলি কিছু?
উমম পড়েই দেখে নিন বরং। তবে এই অদ্ভুত ভাবনাটির জন্য ৩-৪ টির বেশি বাক্য না খরচ করেও এটাকে পাঠকের মনে আলাদাভাবে রাখার কৌশল করেছেন লেখিকা।
৭. কৃষ্ণ ও শকুনির অদ্ভুত এক সমীকরণ। পড়তে পড়তে আপনার মনে হতে বাধ্য দুজন শ্রেষ্ঠ বোদ্ধা, রাজনীতিবিদের চাওয়া কোথায় যেন মিলে যায়।

কি কি ভালো লাগেনি -
১. গান্ধারী ও শকুনির ভাইবোনের সুসম্পর্কের দীর্ঘ ভূমিকা যা অনেকটাই বাহুল্য মনে হয়েছে।
২. রাজসূয় যজ্ঞ চলাকালীন দ্রৌপদী-হিড়িম্বার মধ্যে মেয়েলী ঝগড়াকে এতটা ফোকাস করা বাহুল্যই মনে হয়েছে।
৩. এক দুই জায়গায় হয়তো লেখিকার অসাবধানতাবশত তৎসম শব্দের অবাঞ্ছিত  প্রয়োগে গুরুচন্ডালি দোষ ঘটেছে।

➤  মহাভারতের মতো বিরাট উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকেই বর্ণনা করা হয়েছে ধূসর রূপে। কেউ সম্পূর্ণভাবে ধার্মিক নন, কেউ সম্পূর্ণ অধার্মিকও নয়। তাই মহাভারতকে নতুনভাবে দেখতে চাইলে, শকুনির মতো এক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিমানকে এক ঘৃণ্য খলনায়কের বদলে অন্য রূপে দেখতে চাইলে সুচেতনাদেবীর 'সৌবল শকুনি' বইটি অবশ্যপাঠ্য।

রিভিউটি লিখেছেনঃ শুভদীপ ঘোষ

বই - সৌবল শকুনি 
লেখিকা - সুচেতনা সেন কুমার 
প্রকাশক - একলব্য প্রকাশন 
মুদ্রিত মূল্য- ২৫০ টাকা

এই বই মহাভারতের এক খলনায়কের, প্রতিনায়ক হয়ে ওঠার কাহিনি, এই বই এক পুত্রের প্রতিশোধ এর কাহিনি, এই বই এক ভ্রাতার তাঁর ভগিনীর প্রতি হওয়া অবিচারের কাহিনি, এই বই এক রাজবংশের ক্রূরতা এবং অন্য রাজবংশের সীমাবদ্ধতার কাহিনি।

এই বই যেন এক টুকরো মহাভারত৷ যে চরিত্রকে আমরা ছোট থেকে ঘৃণা করে আসি, সেই চরিত্রকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা। তাঁর পক্ষ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা। সর্বোপরি তাঁর অবস্থান এ দাঁড়িয়ে তাঁকে বোঝার চেষ্টা। 

যাকে এতদিন ঘৃণা করতাম সেই মাতুল শকুনিকে ভালোবেসে ফেললাম। তাঁর জায়গায় থাকলে প্রতিটা মানুষই একই কাজ করতো, সবার আগে সে একজন পুত্র, একজন ভ্রাতা, একজন রাজা। 

নিজের চোখের সামনে সে তাঁর প্রিয় বোনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহকে স্বীকার করে নিয়েছে - ভীষ্মের জন্য বাধ্য হয়েছে । 

চোখের সামনে নিজের পিতার মৃত্যু এবং মাতৃভূমি গান্ধারকে ধ্বংস হতে দেখেছে, যার মূলে ছিলো ভীষ্ম। 
সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন কুরুবংশ বিনাশের, যার মধ্যে সামিল তাঁর পুত্রসম ভাগ্নেরাও। প্রতিশোধের স্পৃহাকে নিজের মনের মধ্যে রেখে দিনের পর দিন হস্তিনাপুর এ তিনি বপন করেছেন হিংসার বীজ, যার পরিণতি কুরুক্ষেত্র। 

বইয়ের শুরু - শেষ সবই যে কোনো পাঠকের জানা, কিন্তু বইটিকে আলাদা করেছে তার গল্প বলার ধরণ, লেখার ধরণ। সঠিক স্থানে উপযুক্ত শব্দচয়ন এবং নির্ভুল মুদ্রণ আলাদা করে প্রশংসার দাবি রাখে। 

বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিতে যুক্তি দিয়ে কিছু ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেমন ভীষ্মের অধিক আয়ুর রহস্য ( সেই যুক্তি অনুসারে ভীষ্ম এতদিন জীবিত থাকলেও, অম্বা কীভাবে শিখন্ডী রূপে এতদিন জীবিত থাকলো - তারও উত্তর দেওয়া রয়েছে বইয়ের শেষের অংশে)। 

শুধু দুটো জায়গাতে আমার একটু অসুবিধা হয়েছে। 

১) গান্ধারীর ১০০ সন্তানের রহস্য ভেদ করলেও, তাঁর মাতার ১০০ সন্তানের জন্মরহস্য নিয়ে দিদি কিছু বলেননি। 

২) একলব্যকে, ধৃষ্টদ্যুম্ন রূপে দেখানোটা মেনে নিতে পারিনি। কারণ যতদূর জানি একলব্য এর পুত্র কৌরবদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছিলো এবং তার-ও পরবর্তীতে কৃষ্ণের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ( যদিও হরিশংকর জলদাসের - "একলব্য"তে খানিক আলাদা আছে)  দুজন ব্যক্তি এক হতে পারেনা। এক্ষেত্রে চিন্তন দার লেখা "অগ্নিজাতকের পরিচয়" অনেক বেশী যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। 

কিছু বই থাকে, যা শেষ করার পর মনে হয় আরও একটু থাকলে ভালো হতো। এই বইটিও সেই গোত্রের। শকুনির জন্য হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে।  বারবার একটাই লাইন মনে পড়ছে 

" শকুনি চোখ বন্ধ করলো। অন্তিম লক্ষ্যের সঙ্গে তার ব্যবধান এখন মাত্র কয়েক মূহুর্তের। "

রিভিউটি লিখেছেনঃ সৌপর্ণ 

Post a Comment

0 Comments