রংঝুরি রহস্য
মৃগঙ্ক ভট্টাচার্য
হিমালয়ের কোলের কাছে যেখানে ডুয়ার্সের সবুজ অরণ্য এসে পা ছুঁয়েছে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ভুটান পাহাড়ের, ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক পাহাড়ি জনপদ রংঝুরি। তার একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে জঙ্গল আর তার গা দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা দোলং নদী। সুন্দর ছিমছাম এই শহরেই প্রতি বছর আয়োজিত হয় বিশাল এক আন্ডার নাইন্টিন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। আসেপাশের নেপাল, ভুটান, কুচবিহার, অসম তো বটেই এমনকি সেই পাটনা কিংবা ত্রিপুরা থেকেও খেলতে আসে নামজাদা সব দল। পুলিশ অফিসার অনিকেতের উদ্যোগে সেখানেই খেলতে যাওয়ার ডাক পায় জলপাইগুড়ির চ্যাম্পিয়ন টিম সবুজ সংঘ।
ক্যাপ্টেন চপ্পল অর্থাৎ চপল আর ভুলু, রাসেল, বাবু, মিঠু পিন্টু, রাসেল এমন একঝাঁক কিশোর বেরিয়ে পড়ে বাইরের পেশাদার দলের বিরুদ্ধে খেলে প্রথমবার ট্রফি ছিনিয়ে এনে নিজেদের সেরা প্রমাণ করার সংকল্প নিয়ে, সঙ্গে চলেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট সনাতনবাবু, জ্যোতিষী গবাবাবু, আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ ডাকুবাবু আর আইনজ্ঞ হিগিনবাবু।
কিন্তু পৌঁছানোর পর থেকেই দেখা যায়, ছবির মত সাজানো নিস্তরঙ্গ রংঝুরি'তে বাতাসে ভাসছে ভয়ঙ্কর কি এক অপরাধের চাপা ইশারা! ডুকপাদের কবরখানা থেকে কারা চুরি করছে একের পর এক লাশ? কিই বা উদ্দেশ্য তাদের? পুলিশ অফিসার অনিকেত কাকু কিভাবে সমাধান করবেন অদ্ভুত এই অপরাধের?
রংঝুরি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ডুকপার হাবভাব এমন সন্দেহজনক কেন? কেনই বা তিনি কথায় কথায় তিনি চাপা হুমকি দেন চপলদের? ঘন্টাখানেক দূরে ভুটান সীমান্তের কাছের গুম্ফায় থাকেন যে লামা, তাঁর কি সত্যিই অলৌকিক ক্ষমতা আছে কোনো? গবাকাকুর যজ্ঞ করে জ্যোতিষমতে শোধিত আংটি, ডাকুকাকুর বিষম ভয়ানক পাঁচন আর সেই লামার দেওয়া মন্ত্রপুত জলের এহ্যস্পর্শে কি বাঘা বিপক্ষ দলকে উড়িয়ে জিতে ফিরবে সবুজ সংঘ? এই নিয়েই রীতিমত জমে উঠেছে গল্প, যা পড়তে শুরু করলে আপনি চট করে ছাড়তে পারবেন বলে তো মনে হয় না।
আসলে প্যাঁচালো মনস্তাত্বিক থ্রিলার কিংবা জটিল সামাজিক গল্পের ফাঁকে, মাঝেমাঝে খুব দরকার পড়ে হালকা কিছু বইয়েরা স্রেফ পড়ার মজা নেওয়ার জন্য, একটু অ্যাডভেঞ্চারের ফুরফুরে বাতাস নেওয়ার জন্য। এই বই সেই উদ্দ্যেশে সফল বলা চলে।
অচেনা জায়গায় গিয়ে একদল কিশোরের অপরাধ আর রহস্যের মাঝে জড়িয়ে যাওয়া - এই ধরনের গল্প কিন্তু আমরা সবাই ছোটবেলা থেকেই অনেক পড়েছি পত্র পত্রিকা আর বিভিন্ন চলতি গল্প সংকলনের পাতায়। সেই হিসেবে প্লট সংক্রান্ত কোনো অভিনবত্বের দাবি জানায়নি এই বই, লেখক সেটা চাপা দেওয়ার চেষ্টাও করেননি। কারণ তিনি জানেন যে সহজ সাদামাটা একটা গল্পকেও ভালো করে বলতে জানলে পাঠকের মন জিতে নেওয়া যায়। বইয়ের অর্ধেক পড়ার পর কি হতে চলছে সেটা হয়তো কিছুটা ধরতে পারবেন কিন্তু তাও অদ্ভুত একটা মুগ্ধতায় কি হয় কি হয় ভাব নিয়ে পাতার পর পাতা উল্টে যেতে ইচ্ছে করবেই। ঝরঝরে ভাষায় উত্তরবঙ্গের প্রকৃতির জীবন্ত বর্ণনা, অসম্ভব দক্ষ চরিত্র চিত্রণ, মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো হাসির মুহূর্ত আর বলিষ্ঠ লেখনীতে ধরে রাখা সাসপেন্স - এই সব মিলিয়ে বইটা, অন্তত একবার হালকা মেজাজে পড়ার জন্য পারফেক্ট। অনেকদিন পর একটা বই পড়ে ভাবনার খোরাক খুঁজতে ইচ্ছে করছে না, শুধুই টাটকা একরাশ ভালোলাগায় ভরে গেল মনটা।
ব্যক্তিগত রেটিং হিসেবে দিলাম : 7/10
রিভিউটি লিখেছেনঃ Metaplastic
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।