বই: জাগরণে যায় বিভাবরী
লেখক: সুস্মিতা জাফর
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: জারীন তাসনিম
ধরন: থ্রিলার
প্রকাশনী: চলন্তিকা
একজন মানবসন্তান প্রথমবার যখন হাঁটতে শিখলো, প্রথমবার যখন কথা বলতে শিখলো, তখন সেটা রপ্ত করে ফেলল সারাজীবনের জন্য। যা সে কখনো ভুলবে না। উপরন্তু একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে সময়, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে। যার সূচনা ঘটে শৈশবে। স্বভাব চরিত্র, মানবিক মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি জীবন-যাপনের কায়দা কানুন শৈশবকালীন সময়েই নির্ধারণ হয়ে যায়। ফলে মানুষ হিসেবে কে কেমন, সেটা তার শৈশব কৈশোর থেকেও ধারণা করা সম্ভব।
জাগরণে যায় বিভাবরী উপন্যাসের গল্প আবর্তিত হয়েছে অভয়নগর শীর্ষক এক মফস্বলের বিশাল প্রাসাদোপম ‘শিউলিবাড়ি’ এবং তাতে বসবাসরত পরিবারকে ঘিরে। মূল চরিত্রে রয়েছে সেই পরিবারের বড় কন্যা পারিজাত আমিন এবং তার ভাষ্য-বর্ণনাতেই পুরো গল্পটি এগিয়ে গেছে।
বাবা-মা, ছোটবোন ইরাবতী, তিন ভাই তারিন, অরিন ও পিয়ালসহ আরও ক’জন মানুষ মিলে পারিজাতের বিশাল পরিবারকে আপাতদৃষ্টিতে সাদামাটা মনে হয়। কিন্তু তাদের বাড়িটিতে কী যেন এক অস্বাভাবিকত্ব আছে। আর পরিবারে রয়েছে অজানা এক রহস্য। এখন ভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য যেটাই বলি, পারিজাতের সমস্ত শৈশব কৈশোর কেটেছে অনাদর অবহেলায়। এমনকি তার জন্মদাত্রী মা তাকে আদর করতেন না, যত্ন নিতেন না। অথচ বাকি সন্তানদের ঠিকই যত্ন নিতেন। কিন্তু কেন? কারণ তো অবশ্যই আছে।
দুঃখ, কষ্ট, দ্বিধা ও হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা পারিজাতের শৈশবটা আরও বেশি জটিল হয়ে যায় যখন তার খুব কাছের মানুষ মারিয়া আন্টির ভিন্নরূপ সামনে আসে। অপরদিকে বাড়িতে ঘটতে থাকে অদ্ভুতুড়ে ঘটনা। কীসের এক ছায়ামূর্তি যেন মসৃণ খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠে যায়। ওটা কি মানুষ না অন্যকিছু? ছেলেবেলার প্রতিবেশী ও খেলার সাথী দিলু ছবি এঁকেই যে কাউকে শাস্তি দিতে পারে। কীভাবে সম্ভব?
এমনই শত শত প্রশ্ন তাড়া করে পারিজাতকে। কিন্তু সে জবাব চায় না। পালাতে চায়। দীর্ঘ একটা সময়ের পর সেটা সম্ভবও হয়। সমস্ত অতীতকে পেছনে ফেলে ডাক্তারি পড়তে শহরে পাড়ি জমায়। তারপর সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ পারিজাতের ছোটবোন ইরাবতী আত্মহত্যা করে। মুহূর্তেই সব এলোমেলো হয়ে যায়।
যে মেয়ে একদিন পরেই জার্মানিতে পড়তে যাবে, প্রাণোচ্ছল ও ভীষণ আত্মবিশ্বাসী সেই মেয়ে হঠাৎ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করল কেন? আবারও রহস্যের জট তৈরি হয়। যার শাখা-প্রশাখা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এবার আর কোনোকিছু এড়ানোর সুযোগ থাকে না। পারিজাত কী পারবে এই ভয়াল রহস্যের সমাধান করতে? সামনে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে? এসকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উপন্যাসের শেষ পাতা অবধি পাঠককে আবদ্ধ থাকতে হবে।
মোট ২০টি অধ্যায়ে বিভক্ত ১৪৯ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের প্রতিটি পাতা হরর, ফ্যান্টাসি, থ্রিলে ভরপুর। চমৎকার ভাষাশৈলী আর নিখুঁত বর্ণনা পড়ার আগ্রহ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। গল্প বলার ঢঙটাও দারুণ। মূল চরিত্রের বর্ণনায় কাহিনিতে ভিন্ন দুটি সময়কালকে উপস্থাপন করা হয়েছে। একটি বর্তমানকাল, অপরটি শৈশবকাল।
গল্পটা শুরু হয় বর্তমানকালে ঘটা আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে। এই ঘটনা পরবর্তী সময়ে পুলিশি তদন্ত, পারিজাতের পেশা জীবন ও ব্যক্তি জীবনের টানাপোড়েন, পরিবারের সদস্যদের মানসিক বিপর্যয় ও অবস্থাকে ঘিরে এক রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।
আর এ রহস্যই আমাদেরকে পারিজাতের শৈশব স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেই সময়গুলোতে কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, সেগুলোর সঙ্গে বর্তমান সময়ের ঘটনাগুলোকে পাশাপাশি রেখে রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করা হয়। এখানে বলতেই হয়- লেখক এই পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। একাধিক সাসপেন্স আর টুইস্ট নিঃসন্দেহে চমকে দেবে আপনাকে।
তবে দারুণ এই উপন্যাসের অতিসামান্য কয়েকটি দুর্বল দিক রয়েছে। পারিজাতের ভাষ্যমতে যেহেতু গল্পটা বলা, চরিত্রের বয়স ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন অনুযায়ী দুটি ভিন্ন সময়ের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু শৈশবকালীন সময়ের কিছু অংশে নড়বড়ে লেগেছে সেটা। কাহিনির আবহটা ৯ম অধ্যায় অর্থাৎ ৬৫ পৃষ্ঠায় গিয়ে পরিবর্তন হয়। অনেকটা কয়েন ফ্লিপ করার মতো।
বলা যায়, এখান থেকেই থ্রিলের শুরু। গল্পের গতিও বেড়ে যায় অনেক। এর আগের অংশটুকুতে অত্যন্ত ধীর গতিতে গল্প এগিয়েছে। যদিও ক্যারেক্টার বিল্ডআপ আর রহস্যের ছক তৈরিতে এটুকু প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চাইলে সেটা আরও সংকুচিত করা যেত। সেইসাথে প্রতিটি অধ্যায়ের একটি করে শিরোনাম দেওয়ার বিষয়টাও কেন জানি অতটা ভালো লাগেনি। মূল গল্প থেকে সরে শিরোনামের অর্থ খুঁজতে গিয়ে কয়েকবার খেই হারিয়েছি। শিরোনাম ছাড়াই পড়তে ভালো লাগছিল।
একটা বিষয়ে না বললেই নয়। এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় প্লাসপয়েন্ট হলো, প্রতিটি অধ্যায়ে ক্লিফহ্যাঙ্গার বিদ্যমান। আপনি একটা অধ্যায় শেষ করবেন, পরবর্তী অধ্যায়টি পড়ার তাড়না অনুভব হবে। অর্থাৎ, একবার পড়া শুরু করলে কাহিনির গভীরে তলিয়ে যেতে আপনি বাধ্য।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Saiful Islam
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।