হারানো সূর্যের খোঁজে - অনির্বান ঘোষ Harano Shurjer Khoje : Anirban Ghosh

হারানো সূর্যের খোঁজে - অনির্বান ঘোষ Harano Shurjer Khoje : Anirban Ghosh

বই- হারানো সূর্যের খোঁজে
লেখক- অনির্বান ঘোষ
প্রকাশক- পত্র ভারতী

 
     "হায়ারোগ্লিফের দেশে" যারা পড়েছেন তাঁরা অনির্বাণ ঘোষের লেখার সঙ্গে ইতিমধ্যেই পরিচিত। পূর্বের বইটিতে ভারতীয় পটভূমি হলেও মিশর ছিল গল্পের কেন্দ্রে, আর এই বইটিতে গল্পের পটভূমিই মিশর। মাঝখানের কিছু সময় অবশ্য গল্পের চরিত্ররা ভারতবর্ষেও কাটিয়েছে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন এই অগস্ত্য চরিত্রটি আমাদের পুরানের অগস্ত্য মুনির কথা মাথায় রেখেই তৈরী করা, যদিও গল্পের নায়ক কোনো অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ঋষি নন, তিনি বৈজ্ঞানিক। ইরতেনসেনু চরিত্রটিও আমাদের বৈদিক যুগের বিদুষী লোপামুদ্রার আখ্যানকে মাথায় রেখে তৈরী করা। এই দুই যুবক যুবতী কীভাবে নিজেদের অজান্তেই এক ষড়যন্ত্রের চক্রব্যূহে প্রবেশ করে ও শেষমেশ তাদের পরিণতি কী হয়, সেই নিয়েই গল্প।

      গল্পের ভালো লাগার দিক বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় লেখকের বিষয়বস্তুর নির্বাচন। পুরান বা মহাকাব্যের বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনাকে লেখক বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর স্থাপিত করতে চেয়েছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর কোনোরকম আঘাত না হেনেই লেখক অতি সুচারুভাবে নিজের উদ্দেশ্য সম্পন্ন করেছেন। বলা যেতে পারে ধর্ম ও বিজ্ঞান এখানে পাশাপাশি হাতে হাত মিলিয়ে হেঁটেছে। বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেখক নিপুণ ভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটিরও বর্ণনা দিয়েছেন যাতে করে  ওই সুপ্রাচীন কালে এমন উন্নত প্রযুক্তির গল্প বলাটা পাঠকের কাছে অতিরঞ্জন মনে না হয়। তাছাড়া প্রাচীন ভারত এবং মিশরের বিজ্ঞান যে কত উন্নত ছিল তা তো প্রমাণিত সত্যই।
        লেখক যে শুধুমাত্র একটি দুর্দান্ত বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছেন তা নয়, সেই বিষয়বস্তুকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রথম থেকে শেষ অবধি টানটান উত্তেজনার সঙ্গে টেনে নিয়ে গিয়েছেন।
          প্রত্যেকটি মুখ্য চরিত্র, তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং পারস্পরিক সম্পর্ক খুব সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে।
          গল্পের সব থেকে ভাল ব্যাপার হল লেখাটি সম্পূর্ণ নির্মেদ। এই ধরণের গল্পে সাধারণত অতি কথনের অবকাশ থাকে, বর্তমান সময়ের চল অনুযায়ী প্রায় উইকিপিডিয়া পেজ তৈরী করে ফেলেন লেখকেরা; অনির্বাণ ঘোষ সেই পথে হাঁটেননি। বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু পরিমিত পরিমাণে, যা পড়তে গিয়ে বিরক্তির উদ্রেগ হয় না।

      সবশেষে আসি খারাপ লাগার দিক গুলোতে। শেষে এসে সত্যিই মনে হল 'এ কী হল, কেন হল...!!!' কেন? মানে কেন? এত সুন্দর একটা উপন্যাস, শুরুর থেকে এত ঢাকঢাক গুড়গুড় কিন্তু শেষে এসে সেই চিরপরিচিত অদ্যিকালের প্লটে ফেলে দিতে হল! বেশি বললে স্পয়লার দেওয়া হয়ে যাবে তাই বেশি বলব না কিন্তু এত সুদীর্ঘ পরিকল্পনার নেপথ্যের কারণটা বড্ড বেশি খেলো লেগেছে; এমনকি গল্পের মাঝখানের অধ্যায়ে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তার সঙ্গে শেষের দিকের কারণটার তো ক্ল্যাশ হচ্ছে বলে মনে হল। আর সব থেকে খারাপ লাগল যে দুটি বিষয়, তার প্রথমটা হল, যে চরিত্রটার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে আপনার ভিলেন বলে মনে হল সেই শেষমেশ ভিলেন বেরোলো। অবশ্য সে ছাড়া আর বেশি চরিত্রও ছিল না ভিলেন করার মত। দ্বিতীয়টি হল, গল্পের নায়ক নায়িকা ছাড়াও কিছু চরিত্র আপনার প্রিয় হয়, শেষে গিয়ে যদি দেখেন সেই রকমই একটি চরিত্রকেও জোর করে ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হল, কেমন লাগবে তখন!

      পরিশেষে বলব, খারাপ লাগার কারণগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত। আপনারও যে খারাপ লাগবে তা কিন্তু নাও হতে পারে। শেষের অংশটুকু বাদ দিলে বাকি গল্পটি ভীষণ রকমের উপভোগ করেছি। নিঃসন্দেহে পড়ার মত একটি বই।
আমার ব্যক্তিগত রেটিং - ৭.৫ / ১০।

📎 আমরা কোনো বিদেশী লেখকের থেকে এই ধরণের লেখা পড়লে বাহবা দিতে দু' বার ভাবি না, অমিশ ত্রিপাঠীরও প্রশংসা করতে পারি কিন্তু বাংলার কোনো লেখক নতুন ধরণের কিছু লিখলেই 'খাজা', 'পয়সা নষ্ট' ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দিই সহজে। অনেকে তো না পড়েই খিল্লি করতে লেগে যান। আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের উন্নতি চাইলে সবার আগে আমাদের মানসিকতার বদলের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের নিজেদের দেশের ক্লাসিক বাদ দিলে নতুন কাজগুলি নিয়ে যে স্টিরিওটাইপ ধারণা গেঁথে যাচ্ছে আমাদের মনে, সেই ধারণাকে সবার আগে উৎখাত করা প্রয়োজন। আজকে হয়ত এই নতুন ধরণের চেষ্টাগুলির মধ্যে পরিনমনতার অভাব থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় উন্নত হবে, একদিনে তো আর মাস্টারপিস তৈরী হয় না।
যাইহোক, অনেক দিন পর গল্পের বই পড়লাম। ভাল লাগল। তাই  হয়ত একটু বেশিই লিখে ফেললাম।


রিভিউটি লিখেছেনঃ Sinchan Nohara

Post a Comment

0 Comments