পুস্তক পর্যালোচনা
বই: গোরস্থানে সাবধান!
লেখক: সত্যজিৎ রায়
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার তথা লেখক সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট ফেলুদা চরিত্রটির আলাদা করে কোনোও পরিচয় দেওয়ার দরকার পড়ে না। বহুকাল যাবৎ বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে ফেলুদা নিঃসন্দেহে এক বিশিষ্ট স্থানাধিকারী। ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় ছোট বড় মোট ৩৩টি সম্পূর্ণ কাহিনী লিখেছিলেন – যার মধ্যে অন্যতম ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এই উপন্যাস “গোরস্থানে সাবধান!”
ফেলুদার গল্প বলতেই আমাদের মনে প্রথমেই যা আসে, তা হলো ভ্রমণ। কখনোও দার্জিলিং, কখনোও গ্যাংটক, কখনোও জয়সলমীরের উষর মরুভূমি, কখনোও বা বরফাবৃত সিমলা বা এলোরার গুহামন্দির। এমন কি উত্তরবঙ্গের জঙ্গলেও ফেলুদার অবাধ বিচরণ। কিন্তু গোরস্থানে সাবধান কাহিনীটি সম্পূর্ণভাবেই কলকাতার প্রেক্ষাপটে এবং কাহিনীর মধ্যে ভ্রমণের বৈচিত্র্য না থাকলেও সত্যজিতের সুলেখনীর ফলে বাঙালীর সুপরিচিত কল্লোলিনীই হয়ে উঠেছে রহস্যের খাসমহল।
কাহিনীর শুরু রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর গাড়ি কেনা দিয়ে। তাঁর সবুজ রঙের সেকেন্ড হ্যান্ড মার্ক টু অ্যাম্বাসাডর চড়ে ফেলুদার যাত্রা শুরু এই কাহিনীতেই। গল্পটা প্রায় সবারই জানা, তাই বিশদে বলছি না – শুধু বলি, জুন মাসের এক বিকেলে এক প্রচণ্ড ঝড়ে সাউথ পার্ক স্ট্রীটের গোরস্থানে নরেন বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির গাছ চাপা পড়ে আহত হওয়ার খবর ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও সেই সঙ্গে গোরস্থান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও ভদ্রলোক সেখানে ছিলেন জেনে তার কৌতূহল বহুগুনে বর্ধিত হয়। তারপর গোরস্থানে গিয়ে ফেলুদা যখন দেখে যেখানে ভদ্রলোক আহত হয়েছিলেন সেখানে একটা অনেক পুরনো কবরের মাটির কিছুটা কেউ খুঁড়ে রেখেছে, তখন তোপসে ও জটায়ুকে সঙ্গে নিয়ে সে পুরোদমে তদন্তে নামে ও এক এক করে পাঠকের পরিচয় হয় টমাস গডউইন নামে উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে সুদূর ইংল্যাণ্ড থেকে কলকাতায় আসা ভাগ্যাণ্বেষী ব্রিটিশ, তার কন্যা শার্লট ও বংশধর মার্কাস গডউইনের সঙ্গে। এছাড়াও কাহিনীতে আসেন নরেন ও গিরীন বিশ্বাস নামক ভাতৃদ্বয় ও ধনকুবের মহাদেব চৌধুরী। এই শেষোক্ত ব্যক্তি এক ঘড়ি বিশেষজ্ঞ তথা সংগ্রাহক এবং অভীপ্স বস্তুটি সোজা পথে না পেলে বাঁকা পথ নিতে দু’বার ভাবেন না তিনি। টমাস গডউইনের কন্যা শার্লট গডউইনের ডায়রী পড়ে ফেলুদা এক রহস্যময় পেরিগ্যাল রিপীটারের কথা জানতে পারে ও যেহেতু রিপীটার শব্দের অর্থ ঘড়ি বা বন্দুক দুটোই হয় তাই সংশয় নিবারণার্থে ফেলুদা শেষপর্যন্ত মহাদেব চৌধুরীর দ্বারস্থ হয় ও কাহিনীও হাইভোল্টেজ ক্লাইম্যাক্সের দিকে অগ্রসর হয়।
কাহিনীর ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে ব্রিটিশশাসিত কলকাতার গৌরবময় অতীত ইতিহাস, মধ্য কলকাতায় তখনোও (১৯৭০-এর দশক) টিকে থাকা ব্রিটিশ পরিবারের দৈন্যদশার বিবরণ ও ঐতিহাসিক বস্তু নিয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীদের লালসার কথা। সব মিলিয়ে কল্লোলিনী কলকাতায় ফেলুদার এই অভিযান পাঠকদের একেবারেই হতাশ করে না। বরং বলা যায় ফেলুদার অন্যান্য যে কোনোও কাহিনীর তুলনায় এটি একেবারেই অন্য স্বাদের, অন্য ধাঁচের। আমার প্রিয়তম ফেলুদা কাহিনী।
২০১০ সালে সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় গোরস্থানে সাবধান উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করেছিলেন। মোটামুটি সবই ঠিক ছিলো, সকলেরই অভিনয় অপূর্ব, গোরস্থানের দৃশ্যপট, পরিবেশ এককথায় অসাধারণ কিন্তু দুটি ক্ষেত্রে ছবিটিকে আমি পুরো নম্বর দিতে পারিনি। ভারতে আসবার পর টমাস গডউইন প্রথম কাজ পেয়েছিলেন লক্ষ্ণৌয়ের নবাব সাদত আলীর বাবুর্চিখানায়। সিনেমায় সাদত আলীর ছবি দেখানো হলেও এই কাহিনীর অন্যতম প্রধান চরিত্র টমাস গডউইনের একটি কাল্পনিক ছবি অতি অবশ্যই দেখানো উচিত ছিলো বলে আমার মনে হয়। দ্বিতীয়তঃ ১৯৭০-এর দশকে পেরিগ্যাল রিপীটার সম্পর্কে জানতে ফেলুদা ঘড়ি বিশেষজ্ঞ মহাদেব চৌধুরীর কাছে গেছিলো কিন্তু ছবিটি যেহেতু বর্তমান যুগের পটভূমিকায় তোলা তাই ফেলুদা ইন্টারনেট থেকে অতি সহজেই পেরিগয়াল রিপীটার জিনিষটা কি তা জেনে নিয়েও কেন মহাদেব চৌধুরীর কাছে গেলো, তার কোনোও প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা পরিচালক দেননি। অন্ততঃ আমার মোটা মাথায় আজও ঢোকেনি।
পর্যালোচকের রেটিং (উপন্যাস): ৯/১০
রিভিউটি লিখেছেনঃ Srijit Mitra
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।