নাম : কুমারজীব
লেখক : সত্যেন সেন
ধরণ : ঐতিহাসিক, জীবনীমূলক উপন্যাস
প্রকাশনী : খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি
মূল্য : ৩০০ টাকা
দেশ : বাংলাদেশ
ভূমিকা
মধ্য এশিয়ার যেই ব্যাপক অঞ্চল এই উপন্যাসের রঙ্গভূমি, এক কালে তা সভ্যতার আলোকে প্রদীপ্ত ও সমুজ্জ্বল ছিল। ভারতবর্ষ থেকে চীনে যাবার দুটি পথ এই অঞ্চলের উপর দিয়ে চলে গেছে। একটি দীর্ঘ ঘোরানো পথ, যার এ পাশে ও পাশে কতগুলি ছোট ছোট রাজ্য ছিল। এই সমস্ত রাজ্যের জনসাধারণের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের ছিল অপ্রতিহত প্রভাব, ভাষার দিক দিয়েও এরা ছিল সংস্কৃতভাষী। সেই কারণে ভারতবর্ষ থেকে বাইরে হলেও এরা ভারতীয়দের সঙ্গে আত্মিক বন্ধন অনুভব করতো। এই সমস্ত রাজ্যের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু বিহার পরিচালিত হত। সেই সকল বিহারে হাজার হাজার বৌদ্ধভিক্ষু শাস্ত্র চর্চা করতেন।
চীনগামী যাত্রীদের এই রাজ্যগুলি ছাড়িয়ে জনবিরল মরুভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হত। ততটা দুর্গম না হলেও এ পথ দিয়ে যাতায়াত করা খুবই দুষ্কর ছিল। কেননা এই জনবিরল দীর্ঘ পথে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে বহু যাত্রীকে প্রাণ দিতে হত। প্রাচীন পর্যটকদের বিবরণে দেখা যায়, তাঁরা এই পথের দুধারে সারি সারি মানুষ ও পশুর কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখেছেন। তা সত্ত্বেও মানুষ এই পথ দিয়ে চলাচল করত। বিশেষ করে দেশ বিদেশের বণিকরা। চীন ও ভারতবর্ষের বৌদ্ধভিক্ষু ও পর্যটকেরা ধর্মীয় শিক্ষালাভের জন্য বা ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এই পথ দিয়ে আসা যাওয়া করতেন।
এ ছাড়া আরও একটি পার্বত্য পথ ছিল। পূর্বোক্ত পথের তুলনায় কিছুটা ছোট হলেও এই পথ ছিল অত্যন্ত দুর্গম ও ভয়াবহ। অতিমাত্রায় দুঃসাহসী লোক ছাড়া আর কেউ এ পথ দিয়ে যেতে সাহস করত না। এই দুটো পথ চীনের প্রবেশ দ্বার তুনহোয়াং-এ গিয়ে মিলিত হয়েছিল।
এই উপন্যাসটিকে আমি ঐতিহাসিক উপন্যাস বলেই দাবী করতে চাই। পাঠকদের মনে স্বাভাবিকভাবে এই কৌতূহল জাগতে পারে যে, এর ঐতিহাসিক কাঠামোটা আমি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছি। এ কথা সত্য, প্রচলিত ইতিহাসের পাতায় এই কাহিনীটিকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই কাহিনী দীর্ঘকাল ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে মাটির তলায় চাপা পড়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাকে সেই বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এই ব্যাপক অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে শুধু যে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছিল তাই নয়, পারস্যের মিথ্রপূজা, জরথুস্তের ধর্ম, মনু-প্রবর্তিত ধর্ম এবং চীনের প্রাচীন ধর্ম এই অঞ্চলের লোকদের মধ্য প্রভাব সৃষ্টি করবে এবং নানা ধর্মের সংমিশ্রণ ও সংঘাত ঘটবে, এটা খুবই স্বাভাবিক।
সোভিয়েট রাশিয়া, ফ্রান্স, আমেরিকা, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা এই অঞ্চলে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করে বহু প্রাচীন পুঁথির উদ্ধার করেছেন। অধিকাংশ পুঁথি পাওয়া গিয়েছে শুকিয়ে যাওয়া অব্যবহার্য কুয়োর মধ্যে। এ কথা বুঝতে বেগ পেতে হয় না, এইসব লোকেরা তাদের শাস্ত্রগ্রন্থগুলিকে রক্ষা করার আর কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে এগুলিকে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। হয়তো এর পিছনে রয়েছে, ধর্ম নিয়ে মারামারি কাটাকাটির এক রক্তাক্ত ইতিহাস। আবার না-ও হতে পারে তা। এক সময় এই সমস্ত অঞ্চলে শক, হুন প্রভৃতি দুর্ধর্ষ জাতিগুলি নিরীহ জনপদবাসীদের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা ক্ষুধার্ত পঙ্গপালের মত দলে দলে তাদের উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত। মেরে কেটে লুটপাট করে যা নিতে পারত নিয়ে নিত, আর যা পারত না, পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে চলে যেত। তাদের আক্রমণের হাত থেকে এই শাস্ত্রগ্রন্থগুলিকে রক্ষা করবার আর কোন পথ তারা খুঁজে পায় নি।
এই পুঁথিগুলির কোন একটিতে বা একাধিক পুঁথিতে কুমারায়ন, জীবা আর কুমারজীবকে কেন্দ্র করে রচিত এই কাহিনীটিকে পাওয়া গিয়েছে। পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকে এই কাহিনীটিকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করেন, আমি তাঁদের এই অভিমত শিরোধার্য করে নিয়েছি।
এই অঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যগুলির মধ্যে অগ্নিরাজ্য, ভরুক ও কুচী— এই তিনটি রাজ্যের একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এই তিন রাজ্যের অধিবাসীদের চেহারা সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে তা থেকে মনে হয় এরা নর্ডিক গোষ্ঠির লোক। এরা সংস্কৃত অর্থাৎ তৎকালীন প্রচলিত সংস্কৃত ভাষায় কথা বলত। কুচী রাজ্যের অধিবাসীদের যে দু-একটি নাম পাওয়া গিয়েছে সেগুলি খাঁটি সংস্কৃত শব্দ।
কুমারজীব যে একজন বৌদ্ধশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন, সে সম্বন্ধে সন্দেহ করবার কারণ নাই। তিনি তাঁর জীবনের শেষ চল্লিশ বৎসর চীনদেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও বৌদ্ধ শাস্ত্রের অনুবাদ কার্যে অতিবাহিত করেন। চীন দেশের সাহিত্য কুমারজীবের স্মৃতি বহন করে আছে। এই কাহিনীর আনুমানিক ঘটনাকাল খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী ।
- সত্যেন সেন
রিভিউঃ
মধ্য এশিয়ার একটি অঞ্চল যা এককালে ছিল উজ্জ্বল সভ্যতার নিদর্শন। সেখানে বৌদ্ধধর্মের ছিল অমিততেজা প্রভাব। ভাষা সংস্কৃত। অঞ্চলটির বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের পরিচালনায় পরিচালিত হত একাধিক বৌদ্ধবিহার। বিহারগুলোয় অজস্র বৌদ্ধভিক্ষু শাস্ত্র চর্চা করতেন। এছাড়াও সেখানে পারস্যের মিথ্রপূজা, চীনের প্রাচীন ধর্ম, মনু-প্রবর্তিত ধর্ম প্রভাবিতকরণের চেষ্টা করেছিল এবং সংমিশ্রণ ও সংঘাত ঘটা অস্বাভাবিক ছিল না।
আজকের সময়ে বিভিন্ন উন্নত দেশের প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ওই অঞ্চলে খুঁজে পেয়েছেন বহু প্রাচীন পুঁথি। যার অধিকাংশ অব্যবহার্য কুয়ো থেকে উদ্ধারকৃত। হয়তো সেগুলো রক্ষার তাগাদায় উপায়ান্তর না পেয়ে অগত্যা কুয়োয় ফেলে দিয়েছিল আর এর পেছনে হয়তো সক্রিয় আছে তৎকালীন দুর্ধর্ষ গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতার ইতিহাস।
উদ্ধারকৃত পুঁথিগুলোর একাধিক পুঁথিতে কুমারায়ন, জীবা আর কুমারজীবকে উপজীব্য করে রচিত একটি কাহিনী পাওয়া গেছে। এই কাহিনী এখন বক্ষ্যমাণ উপন্যাসের উপজীব্য। কাহিনীটির ঘটনাকাল খ্রিষ্টীয় ৩য় শতক অনুমিত।
কুমারজীব বৌদ্ধশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ববান ছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ ৪০ বছর চীনে কাটিয়ে দেন বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারণ কাজে। বৌদ্ধশাস্ত্রাদির অনুবাদকার্যেও লিপ্ত ছিলেন। কুমারজীবের স্মৃতি বহন করে আছে চীনা সাহিত্য। বক্ষ্যমাণ উপন্যাসের কল্যাণে তাঁর স্মৃতি বহন করে থাকবে বাংলা সাহিত্যও।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Afzal Munna
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।