বই - কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ
লেখক - সন্মাত্রানন্দ
প্রকাশক - ধানসিঁড়ি
মুদ্রিত মূল্য - ২৭৫ টাকা
বইটি বারোটি গল্পের সংকলন। বইটি প্রসঙ্গে লেখক এর বক্তব্য তাঁর গুরুআচার্যরা তাকে শাস্ত্রাদি পড়ানোর পাশাপাশি গল্পচ্ছলে নানা পণ্ডিত, সাধক, দেশপ্রেমিক, দার্শনিক এর জীবনকথা শোনাতেন। সেই সমস্ত গুণীজনদের লেখক নিজের কল্পনায় ধারণ করেছেন , তাদেরকে পৃথিবীর মনশ্চক্ষে দেখার চেষ্টা করেছেন। এই বই সেই দেখার নির্যাস। এই গল্পগুলো প্রত্যেকটি ইতিহাস নির্ভর। কোনটি ইতিহাস আশ্রয়ী, কোনটি ইতিহাসসাপেক্ষ আবার কোনটি ইতিহাস সংলঙ্গ।
সংকলনের ১২ টি গল্পের মধ্যে ৮ টি গল্প নিয়ে আমি যৎসামান্য আলোচনা করছি। বাকি তোলা রইলো আপনাদের জন্য।
১) কাশজ্যোৎস্না - শহরের কোলাহল থেকে খানিক ছুটি পাওয়ার উদ্দেশ্যে লেখক যাত্রা করেন রূপনারানের কূলে। পাঁশকুড়া লোকাল ধরে পৌঁছে যান দেউলটি স্টেশন এ। মুগদ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেন রূপনারানের শোভা। শরৎ এর হাওয়ায় আর কাশজঙ্গলের সৌন্দর্যে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি কিন্তু যখন উঠলেন চিনতে পারছেন না সেই স্টেশন, ক্রোশ এর পর ক্রোশ হেঁটে চলেছেন , চিনতে পারছেন না কিছুই। ঠিক সেই সময়েই তার সাথে দেখা হয় এক বৃদ্ধ লোকের। গল্পচ্ছলে সেই আপাত পাগল প্রকৃতির সেই লোক কথককে জানায় যে তিনি দিবাকর চক্রবর্তী, বিজয়মঙ্গল এর রচয়িতা। তারপর কী সেই বিজয়মঙ্গল এর ইতিহাস? আর কী জানালো বৃদ্ধ ভদ্রলোক, কথককে ?
৩) তর্কালংকারের পাতরা এবং ৪) কালান্তর - গল্পদুটি একে অপরের সাথে যুক্ত। আচ্ছা আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে এই যে আমরা বলি বইপত্র, পুঁথিপত্র, শেষে পত্র যোগ করি কেন? পত্র মানে তো চিঠি বা গাছের পাতা। কিন্তু পুঁথির পাশে চিঠি বসানোর অর্থ কী? এই প্রশ্নর উত্তরই লেখক দিয়ে গিয়েছেন এই গল্পে। এসেছে শ্রীনাথ তর্কালঙ্কার, রামমাণিক্য তর্কালঙ্কার এবং সবশেষে বিদ্যাসাগর এর প্রসঙ্গ। যারা মনে করতেন বিদ্যা হওয়া উচিত সকল এর জন্য উন্মুক্ত। লেখক বলছেন এই গল্পে ইতিহাসই বেশি, খানিক শুধু কল্পনা।
৫) বিদ্যালঙ্কার এর বিভ্রাট- গল্পের কেন্দ্রবিন্দু বাণেশ্বর। প্রদীপ্ত যৌবনকালে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় তিনি পুরাণ পাঠ করে শোনাতেন। কিন্তু মিথ্যে রাজস্তুতিতে তার ছিল ঘোরতর আপত্তি। যৌবনের জোশ এ হোশ খুইয়ে মহারাজ এর সামনেই ভুল ধরলেন এক নবীন কবির যে রাজস্তুতি করে মহারাজ এর বন্দনা করছিলেন। পরিণতি যা হওয়ার তাই হলো - পত্রপাঠ বিদায়, জীবনের ছায়াপথ ধরে আসলেন রাজা চিত্রসেন এর পন্ডিতসভায়। রাজা চিত্রসেন ও বললেন তার জীবনগাঁথা লিখতে। নামও ঠিক করা হলো *চিত্রচম্পু*। এদিকে রাজাদের জীবনে ঘটনার বড়োই অভাব। আর মিথ্যে বন্দনার পক্ষপাতী তিনি নন। ঠিক সেই সময়েই বাংলা আক্রমণ করে নাগপুর এর ভাস্কর পন্ডিতের সৈন্যদল বারগিররা। স্থানীয় লোকে বলে বর্গি। তারপর কী হলো বাণেশ্বর এর ? তাঁর "চিত্রচম্পু" এর?
৬) বঙ্গাল - কাহিনীর সময়কাল ১৫৭২-১৫৭৬ পাঠান রাজপাট এর সময়। বিরূপাক্ষ তর্কালঙ্কার এর নিজের পুত্র শ্রীধর, শ্রেষ্ঠ শিষ্যও বটে, মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। সংস্কৃতগন্ধী ছেড়ে এক বিচিত্র ভাষায় কথা বলে। সপ্তাহ না বলিয়া "হপ্তে" বলে, অদ্য না বলিয়া "এঁমঁরুজ" বলে সুপ্রভাত না বলিয়া "শোভ বে খে" বলে। এবং নাম পরিবর্তন করে নাম রেখেছে জুলহাস মল্লিক।
বিরূপাক্ষের মা অবশ্য লোকচলিত বঙ্গাল ভাষায় কথা বলেন। বিরুপাক্ষের মনে হয় "কী যুগই না পড়িল , হিন্দু রাজা বিদায় হইয়া, পাঠান অধিকারে দেশ অধিকৃত হইলো। … হায় দেবভাষা তোমার গৌরবরবি অস্তাচলগামী" কিন্তু পাশাপাশি এও মনে করলো যে সংস্কৃত যদি শাশ্বত ভাষাই হয় তাহলে কেউ তা ব্যবহার করেন কেন? কী ভাবে খুঁজে পাবে সে এই প্রশ্নের উত্তর?
৭) একনয়ন - পন্ডিতশিরোমণি রঘুনাথ, ছোট থেকে তার এক চোখ অন্ধ হওয়ায় সারাজীবন তাকে "কানা রঘুনাথ" শব্দটি শুনতে হয়েছে।কিন্তু সেসব এর তোয়াক্কা না করেই তিনি বিদ্যা অধ্যয়ন করেছেন। হয়ে উঠেছেন নবদ্বীপ এর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। সারাদিন পুঁথির মধ্যে ডুবে থাকা রঘুনাথ এর মনে একটাই রাগ। তাঁরই পূর্বপরিচিত নিমাই যে কিনা আগে শাস্ত্রে প্রবল বিদ্যান ছিলেন সে হঠাৎ করে কাশী থেকে পিতার শ্রাদ্ধশান্তি করে ফিরে এসে নিজের টোল তুলে দিয়েছে। এখন শুধু কৃষ্ণ নাম করে আর চোখ দিয়ে কেবল জল পড়ে। কিন্তু রঘুনাথ এর ছাত্ররাও এখন সেই শোভাযাত্রায় যোগ দেয়। পড়াশোনা বিসর্জন দিয়ে খালি কৃষ্ণনাম করে। শাস্ত্রে, ব্যাকরণ এ তাদের মন নেই। এই নিয়েই রঘুনাথ ভাবে, তার স্ত্রী যখন তাকে জিজ্ঞাসা করে যে তিনি কখনো তার সহধর্মিনী নিয়ে কিছু লিখেছেন কিনা, তার পুত্র কে নিয়ে কিছু লিখেছেন কিনা, রঘুনাথ জবাব দিতে পারে না। তার মনে কেবল একটি প্রশ্নেরই উদয় হয়, যখন বহুবছর পরে ভাষাবদলে যাবে, কে তখন তার লেখা পড়বে, কে বুঝবে।..আচ্ছা সেই নিমাই এর ব্যাকুলতা, আন্তরিকতা, প্রেমগান এসব কি একই থাকবে নাকি সব পরিবর্তিত হয়ে যাবে?
৯) শশার ফুলের নূর - আউল বাউল সাঁই, তাহার উপর নাই। ছোট থেকে এই কথাই শুনে এসেছে জুলফিকর কিন্তু তার মনের সব জ্বালা দূর করবে এরকম সাঁই এর সে খোঁজ পায়নি। তার মুরশিদ তাকে বলেছিলেন "যার ভেতর দেখবি ভেদাভেদ নেই তিনিই সাঁই"। একদিন বিকেলে সে দেখে যে দুজন সাধু পাহাড় বেয়ে আলমোড়া শহরের দিকে আসছেন। কিন্তু এক সাধু ভীষণ ক্লান্ত আর পাহাড় এর উপর এ পৌঁছেই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জুলফিকর তার বাড়ি থেকে শশা নিয়ে গেলে সেই সাধু তাকে নিজে হাতে খাইয়ে দিতে বললেন। কিন্তু মুসলমান এর চোখে তো হিন্দুরা কাফের। মুসলমান এর ছোঁয়া খাবার খেলে তো হিন্দুদের জাত যায়, সাধুকে সেটা বলতেই সে বললো ‘ভুখে লোগো কী কোঈ জাতি নেহি হোতি, কোঈ ধর্ম নেহি হোতা” কী অদ্ভুত, এতো সুন্দর কথা তো কেউ বলেনি জুলফিকর কে। যে ক্ষুধার্ত সে হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়, সে মানুষ। তাহলে জুলফিকর কি খুঁজে পেলো তার সাঁইকে, আর কে সেই সন্যাসী যে দর্শনের এতো গভীর কথাটা এতো সহজে বলে দিলো?
১১) নষ্টনাটক - ত্রিশ বছর আগের কথা, কথক তখন মাদ্রাজ এ। চাকরিবাকরি সব বিস্বাদ মনে হচ্ছে, সন্ন্যাসীর জীবন নেয়ার জন্য তিনি গিয়েছেন মঠ এ। মঠের অধ্যক্ষ মোহন মহারাজ এর অনুমতি নিয়ে তিনি সেখানেই পুরোনো ডিসপেনসারিতে থাকতে শুরু করলেন। কিন্তু রাতে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে, সারাঘরে কীসের একটা সুগন্ধ। কী রহস্য লুকিয়ে আছে সেই মঠের ডিসপেনসারিতে? গল্পটির প্রকৃতি সংকলিত বাকি গল্প গুলোর তুলনায় ভিন্ন। লেখক এর ভাষায় “প্রায় ভৌতিক গল্প”।
রয়েছে আরো ৪ টি গল্প - ২) শিখিবৈবশী ও লালপাথরের বাটি ৮) টুপটিকা, ১০) ভাজামউরির কৌটো (দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বের এক চিঠির গল্প), ১২) কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ (তন্ত্রনির্ভর এক আখ্যান, যা একটি প্রাচীন পরিবার এর কিংবদন্তি থেকে নেওয়া হয়েছে)
অনেকটা বড়ো হয়ে গেলো। আসলে প্রতিটা গল্পই এতো মৌলিক যে প্রতিটারই আলাদা করে পাঠপ্রতিক্রিয়া দেওয়া যায়।
বইটি আমার খুবই ভালো লেগেছে। শুধু বলবো এ বই সবার জন্য নয়। যারা একটু ভিন্নধারার বই পড়তে ভালোবাসেন, বাংলার কঠিন শব্দ যাদের পড়ার গতিকে শ্লথ করেনা, তারা অবশ্যই একবার এই বই পড়ে দেখতে পারেন।
পূজা প্রায় এসেই গেলো। লেখক এর কথা দিয়েই শেষ করি পাঠপ্রতিক্রিয়া
"ভাদ্রের সান্দ্র আকাশ ময়ূরকণ্ঠী হইলো, তাহার ডানায় ডানায় কাশমেঘ পশমিনা তুলি বুলাইয়া সাদা রঙের বুটিদার নকশা আঁকিতেছে। … প্রকান্ড বালুচর জুড়িয়া আজ অন্তহীন কাশফুলের সমুদ্র। তাহাদের শুভ্রতার কোনো উপমা নাই , শরতলক্ষ্মী প্রগলভা বালিকার মতো হাসছে।"
প্রতীক্ষার আর ৪৭ দিন
*প্রতিটা উপহার হোক বই*
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।