কালসন্দর্ভা - অঙ্কিতা
কৈফিয়ত
অলৌকিক অতীন্দ্রিয় জগতের ব্যাপারে আমার প্রথম আগ্রহ জন্মায় “দেবযান” পড়াকালীন । গল্পটি ফ্যান্টাসি নাকি আমাদের জগতেরই এক অন্য রূপ তা বুঝতে পারিনি বহুকাল। সেই সময়ই হাতে আসে “অলাতচক্র” বইটি। সেই প্রথম “তন্ত্র” নামক এই অদ্ভুত ধর্মাচরণটি আমাকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য পরে ক্রমাগত বিজ্ঞান চর্চার ফলে তন্ত্রের প্রতি, অলৌকিক জগতের প্রতি আমার সেই আগ্রহ ক্রমশ কমে আসে।
বছর কয়েক আগে পর্যন্তও তন্ত্রের ওপরে কিছু ফিকশনাল গল্প-উপন্যাস ছাড়া আমার আর কিছুই পড়া হয়ে ওঠেনি। একদিন রাঢ় বাংলার পটভূমিতে একটা থ্রিলার গল্পের প্লট ভাবতে ভাবতে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। তার কাছ থেকেই একটা অদ্ভুত তথ্য জানতে পারি-তিনটে শক্তিপীঠ দিয়ে তৈরি একটি ত্রিভুজের নাভিবিন্দুতে যদি কেউ জন্মায় তাহলে সে নাকি মহান সাধক হয়। সাধক বামাখেপা নাকি জন্মেছিলেন সেরকম ক্ষেত্রে।
সেই সময় তারাপীঠ বেড়াতে গিয়ে এই ছোট্ট গল্পটা আমি আবারও শুনি এক পুরোহিতের মুখে। এই দু-লাইনের তথ্যটুকু ছাড়া কেউই আর কিছুই বলতে পারেনি । কোন কোন শক্তিপীঠ? কীরকম ত্রিভুজ? ত্রিভুজের নাভি মানে কী ভরকেন্দ্র? নাকি কোনো বিশেষ তান্ত্রিক শব্দ? কিছুই তারা বলতে পারেনি।
তবে তন্ত্রের সঙ্গে অঙ্কের এইটুকু মিল পেয়েই আমি উৎসাহিত হয়ে উঠি। অবশ্য হাজার খুঁজে কোনো বইতে এই ব্যাপারে কিছুই পাইনি। তারপর গুগল ম্যাপের সাহায্যে শক্তিপীঠগুলোকে খুঁজে খুঁজে ওই তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করি। এবং সত্যি সত্যি স্থানগুলোর মধ্যে এক বিশেষ জ্যামিতিক আকৃতি খুঁজে পাই । এই উপন্যাসে তথ্যটা ভাগ করে নিয়েছি পাঠক বন্ধুদের সঙ্গে।
এরপরে উৎসাহিত হয়ে তন্ত্রশাস্ত্র ও তন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত পড়াশোনা শুরু করি। ভারতে তন্ত্রের উৎপত্তি এবং বিস্তার নিয়ে বিস্তর গবেষণার অবকাশ রয়েছে। এর প্রথম কারণ হিসাবে বলা যায়, এই বিশাল উপমহাদেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা বিচিত্র, বিভিন্ন সব তন্ত্রশাস্ত্র এবং দ্বিতীয়ত এসব শাস্ত্রের ব্যাপারে সমকালীন সাহিত্য এবং ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতার অভাব।
তন্ত্রের গোড়া খুঁজতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরাণ বা লোককথায় এসে ধাক্কা খেতে হয়—যাকে ইতিহাস বলে মেনে নিতে ঐতিহাসিকদের ঘোর আপত্তি আছে। এই উপন্যাসেও সেই দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়েছে। ক্রমে আমার থ্রিলার গল্পের প্লটে মিশতে থাকে বিভিন্ন তান্ত্রিক প্রথা, তন্ত্রের ইতিহাস, পুরাণ এবং অতি অবশ্যই এক অলৌকিক জগতের গল্পও।
উপন্যাসের মধ্যে বেশ কিছু গোষ্ঠীর নাম, তাদের উপাসনা পদ্ধতি এবং ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক ঘটনার উল্লেখ করেছি। চিরপ্রণম্য সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস “প্রথম আলো”র কৈফিয়ৎ-এ যা বলেছিলেন, সেই মহাজনপদাঙ্ক অনুসরণ করে আমিও বলতে চাই, গল্পের চরিত্ররা এবং ঘটনাবলী সবটাই কাল্পনিক, কিন্তু পুরাণ আর ইতিহাস অংশটুকু নির্জলা সত্য। রৌম্য, ভৈরব ইত্যাদি চরিত্রগুলো আমি পুরাণের বিভিন্ন বই থেকে গ্রহণ করেছি একইভাবে সুতিয়া, আহোম, দেওরী প্রভৃতি গোষ্ঠীদের খুঁজে নিয়েছি ভারতের ইতিহাস থেকে।
যখন উপন্যাসটা লিখতে শুরু করি তখন ভেবেছিলাম এটা বড়োজোর হাজার কুড়ি শব্দের একটা থ্রিলার উপন্যাসিকা হবে। কিন্তু কখন যে আমার হাত থেকে রাশ কেড়ে নিয়ে চরিত্ররাই ঘটনাক্রমকে চালনা করতে শুরু করল তা টেরই পেলাম না। মাসচারেক পর যখন উপন্যাসের প্রথম ড্রাফট লিখে শেষ করলাম, তখন দেখলাম শব্দসংখ্যা সত্তর হাজার ছুঁই ছুঁই।
নবাগত লেখকের পক্ষে এরকম এক বিশাল বপু উপন্যাসের জন্ম দেওয়া অনেকটা সন্তান জন্ম দেওয়ার মতোই। জন্ম দিয়ে মায়ের মন তো অনির্বচনীয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে যায়, কিন্তু একই সঙ্গে মাথায় ঢোকে সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তাও। সেই চিন্তা থেকে আমাকে মুক্ত করেছে হ কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস। তাদের আশ্বাস- বাণীতেই শব্দ সংখ্যার কোনো বিশেষ বাঁধনে বাঁধা পড়তে হয়নি আমার এই উপন্যাসকে।
উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে যারা তাদের সুচিন্তিত মতামত দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন তাদের প্রত্যেকের কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ।
এছাড়াও এই দীর্ঘ গবেষণাধর্মী উপন্যাসের অবিরাম আর জটিল চলন যখনই আমাকে ক্লান্ত করেছে, তখন যে মানুষটার ক্রমাগত উৎসাহে আমি আবার পথ খুঁজে পেয়েছি, যার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ছাড়া এত কম সময়ে কিছুতেই এই উপন্যাসটি বই আকারে পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারতাম না, আমার সেই চিরসাথীকে প্রণাম ।
“কালসন্দর্ভা”র কল্পবিশ্ব সংস্করণ পড়ে অনেকেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আমার প্রথম বই পাঠকদের কাছে এমন বিপুল সমাদৃত হবে তা আমি আগে ভাবিনি। আমার সব পাঠকের জন্য ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। বর্তমানে বইটির বাংলাদেশী সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। এর জন্য ভূমিপ্রকাশের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। আশা করি বাংলাদেশী বন্ধুরাও সাদরে গ্রহণ করবেন আমার এই লেখা।
সকলের মঙ্গলময় জীবন প্রার্থনা করি-সবাইকে ধন্যবাদ।
অঙ্কিতা
ankitamaity 88@gmail.com
রিভিউঃ
কয়েক বছর আগে, জটিলতন্ত্রের উপাচারের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসে (জন্মায়নি) এক বিশাক্ত শিশু (বীজ)। কয়েক বছর পরে বোলপুরের এক বনেদি পরিবারে এসে পৌছোয় সেই মেয়েটি। সময় ঘনিয়ে এসেছে সেই মুহূর্তের যেখানে বীজ শিশুটি খুলে দেবে নরকের দ্বার আর পৃথিবীর বুকে ফিরে আসবে এক নারকীয় আক্রোশ।
ভালোঃ বইটির মলাট ও বর্ণনা খুবই চোখ টানে। বইটি পড়ার মূল কারণ ছিল সেটিই। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি উপভোগ্য বই। গ্রামের সাথে শহরের সংমিশ্রণ বেশ ভালো। ধর্ম, অবাধ্য প্রেম, মার-কাটারি অ্যাকশন, ভালো লাগার মত চরিত্র বইটির প্লাস পয়েন্ট। বইটি অসরলরৈখিক ভাবে লেখা হলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না।
খারাপঃ আগেই বলে দিই, হয়তো আমি নিজেই অতিরিক্ত আশা করেছিলাম বলে হতাশ হয়েছি। মুড়ি-মুড়কির মতো কথায় কথায় বশীকরণ, উচাটন (যেন ট্রেনের জানলায় বিজ্ঞাপন) আর গোটা বাড়ি ভর্তি শিক্ষিত লোকের অন্ধবিশ্বাসী আচরণ খুব অদ্ভুত। লেখার বাঁধুনি বেশ বেশ ঢিলে ও দায়সারা। কাঁচা হাতের লেখার ছাপ অনেক জায়গায় বাক্য ও শব্দ চয়নে স্পষ্ট। শহুরে মেয়ের মুখে অকারণে, সাহিত্যিকের মতো কথাবার্তা বড়ো বেমানান। তন্ত্রের উপাচার এই বইতে যেমন ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা, তেমনি জায়গায় জায়গায় অনেক অনেক জাদুবিদ্যা নেহাতই মুস্কিল আসান করার খেলো উপায়। Dues ex Machina (হঠাত করে কেউ বা কিছুর দ্বারা সমস্ত কিছু সমাধান হয়ে যাওয়া)-তে এই বই আষক্ত। অনেকবারই মনে হয়, এমন যদি পারতই, তবে আগে করল না কেন?
রেটিংঃ ৪/১০
নতুন ধরনের লেখা ও অনেক পড়াশোনার জন্য আরও দিতে চাইলেও দেওয়া সম্ভব নয়।
রিভিউটি লিখেছেনঃ তিতাস
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।