উপন্যাস: এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শীর্ষেন্দু বাবু আর তাঁর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ আমাদের মত মধ্য কৈশোর দের কাছে নস্টালজিয়া তবে এই গল্প যেনো অদ্ভুতুড়ে নয় অনেকটা বাস্তবচিত্র, বাস্তবচিত উপন্যাস।
গল্পের মুখ্য চরিত্র শ্যাডো সেনগুপ্ত, যে তার বাবার ব্রেন টিউমার এর অপারেশন করতে চায় কিন্তু লাগবে অনেক টাকা তাই করতে হবে খুন এক সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকে? শ্যাডোর বাবা কি বাঁচবে? বাঁচলেও বাবার সামনে মুখ দেখাবে কীকরে শ্যাডো?
রয়েছেন খামখেয়ালী বিজ্ঞান মনষ্ক গজপতি যিনি এমন কিছু আবিস্কার করতে চান যা মানবসভ্যতার কাজে আসবে, তার সঙ্গে দেখা হয় এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালার যে তাকে নানাসময় দিয়ে যায় হুইসেল, টর্চ, লাট্টু প্রসঙ্গত উল্লেখ্য হুইসেলে শব্দ নয় গন্ধ বেরোয়, টর্চ আর লাট্টু টা কি করে জানতে হলে গোগ্রাসে গিলে ফেলুন আরো একবার প্রিয় লেখকের উপন্যাস।
এই উপন্যাস মানবসভ্যতার পরিণতির কথা বলে, মর্মস্পর্শীতার বার্তা দিয়ে যায় শেষের টুইস্ট এ এই উপন্যাস অনন্য।
রেটিং : ৩.৫/৫
গল্পের নাম - এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা
লেখক - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শ্যাডো নামক এক যুবকের বাবার ব্রেন টিউমার ধরা পরে। তার অপারেশনের জন্য 5 লাখ টাকার দরকার। এই সময় শ্যাডো র সঙ্গে কয়েকজন লোক দেখা করে জানায় তারা টাকা দিতে রাজি কিন্তু বিনিময়ে তাকে একজনকে খুন করতে হবে। শ্যাডো উপায়ান্তর না দেখে ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। এদিকে এক অচেনা অদ্ভুত ফেরিওয়ালা এসে ফিজিক্স নিয়ে রিসার্চ করা গজপতিবাবুকে অদ্ভুত জিনিস দিয়ে যাচ্ছে। এমন হুইসেল দিয়েছে, যা দিয়ে শব্দের বদলে গন্ধ বের হয়, যে গন্ধে মশা মাছি থাকে না। এমন টর্চ দিয়েছে যাতে আলো বেরোয় না কিন্তু কুয়াশার দিকে তাক করে জ্বালালে কুয়াশা কেটে যায়। গজপতি বাবু এ রহস্যের কিনারা করতে বদ্ধ পরিকর, কিন্তু বাড়িতে তার স্ত্রী সুচরিতা দেবী ভাবেন তার মাথার দোষ হয়েছে। এদিকে ধূর্ত চাকর গোপাল সর্বদাই তার থেকে ছলে-বলে টাকা হাতিয়ে নেয়। ফলে একমাত্র রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার সুরেশবাবু ছাড়া আর কারুর সাথেই তিনি এই নিয়ে আলোচনা করতে পারেন না।
শ্যাডো কি পারবে মিশন কমপ্লিট করে বাবার অপারেশনের জন্য টাকা জোগাড় করতে? গজপতি বাবু কি বন্ধু সুরেশের সাহায্যে এই অদ্ভুত জিনিশগুলির রহস্য সমাধান করতে পারবেন? কে এই আশ্চর্য ফেরিওয়ালা? এই অদ্ভুত জিনিসগুলি কেনই বা সে গজপতিবাবুকে দিয়ে যায়? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে অবশ্যই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর লেখা "এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা" পড়ে দেখতে হবে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের গল্পগুলোর সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এই গল্পটি লেখা। গল্পের শেষে একটা টুইস্ট আছে, সেটা আর এখানে লিখলাম না। আমার তো বেশ ভালোই লেগেছে। আশা করি আপনাদের ভালোই লাগবে।
ধন্যবাদ।
উপন্যাস এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
আনন্দমেলা ১৪২৯
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এখনো লিখে চলেছেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে। আশি পেরানো মানুষটি আজও কৈশোরের কাছে এক অনাবিল আনন্দের দরজা খুলে দেন। চারপাশে জটিল প্রতিযোগিতাসর্বস জীবনের মধ্যে থেকেও এক সুন্দর বিশ্বাসের জগৎ ভালোবাসার জগতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ছোটদের আনন্দময় মুক্তি ঘটে আর অলক্ষ্যে তাদের মধ্যে তিনি সঞ্চারিত করে দেন এই পৃথিবী এই জীবনের প্রতি ভালোবাসা আদর্শবোধের, তিনি পরিচয় করিয়ে দেন এই স্বার্থসর্বস্ব পৃথিবীতেও কিছু নিতান্ত ভালো মানুষের সঙ্গে চালাকিসর্বস্ব দ্রুতগতির অতি আধুনিক জীবনের মধ্যেও বেঁচে থাকে যে এক ভালো লাগার পৃথিবী, শীর্ষেন্দুর হাত ধরে সেই পৃথিবীতে ক্ষণিক আনন্দ অভিযান ঘটে। তাঁর গল্পের পাঠকদের।
সময়ের সরণিতে এক সময়চারী পথিক সুদুর কালপ্রবাহের ওপার থেকে এসে বর্তমান শতকের পৃথিবীতে মাঝে মাঝে ফেরি করে আশ্চর্য কিন্তু জিনিস। এমন একটা টর্চ। যাতে আলো জ্বলে না, এমন এক লাইটু যা লেত্তি ছাড়াই সঠিকভাবে চালালে অনন্তকাল ঘুরে চলে এমন এক বাঁশি যা বাজে না। অথচ অন্তরালে ঘটে চলে কিছু আশ্চর্য ঘটনা। সেই টর্চ আলো জ্বালায় না, কিন্তু সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে সুদূরের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে অথবা অন্ধকারের মধ্যেই দৃশ্যমান করে তোলে অনেক কিছু। সেই লাটুর ঘূর্ণনে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন উৎপন্ন হতে থাকে অবিরল। আর সে নিঃশব্দ বাঁশির অশ্রুত তরঙ্গ ক্ষতিকর পতঙ্গাদের সরিয়ে দেয় অনেক দূরে। গজাপতি একজন ভালোমানুষ বিজ্ঞানী যাকে সাধারণে চিনতে পারে না, তার মর্যাদা দেয় না। বাড়ির ভৃত্য পর্যন্ত অবিরাম ঠকিয়ে চলে যে মানুষটিকে একদিন তিনিই পৃথিবীর দূষণ প্রতিরোধে আশ্চর্যভাবে প্রায় সফল হয়েছিলেন। শুধু ষড়যন্ত্রকারী কিছু মানুষের লোভ আর স্বার্থসিদ্ধির কারণে সে বিজ্ঞান গবেষণা অসময়ে খেয়ে গেছিল। এই ফেরিওয়ালার তুচ্ছ খেলনাগুলি কোথাও তাঁকে আকর্ষণ করে আর সঠিক মানুষের হাতেই ভবিষ্যতের বিজ্ঞানের যন্ত্রগুলি যথাযথভাবে কাজ করে। কিন্তু গল্প তো এখানেই থামে না। আধুনিক জটিল জীবনকে কৈশোরের সঙ্গে লেখক পরিচয় করিয়ে দেন। শুধু অনন্ত রূপকথা বলেন না। তাই এখানে আসে কিছু গুন্ডা প্রকৃতির লোক যারা মানুষের মঙ্গলের বদলে অর্থ ক্ষমতা আর আধিপত্য দখল করতে সেইসব যন্ত্র আত্মসাৎ করতে চায়। ভবিষ্যতের বিজ্ঞানকে বর্তমান কালপ্রবাহে নিয়ে এসে ফেলেও এই সুবিধাবাদী লোকদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে শুরু হয় সংঘাত। মাঝখানে চলে আসে শ্যাডোর
মতো কিছু মধ্যবিত্ত আদর্শবাদী অথচ নিরুপায় মানুষ যাদের অভাব ও অসহায়তাকে ব্যবহার করে কার্যসিদ্ধি করতে চায় এসব নিয়ন্ত্রক মানুষের দল। যদিও শেষ পর্যন্ত শীর্ষেন্দুর গল্পের ধারা মেনে খারাপ মানুষেরা শান্তি পায়, ভালো মানুষদের কোন ক্ষতি হয় না। আর গল্পের সময়চারী পথিক আশা রেখে যায় আগামী দিনের এমন এক পৃথিবীর যেদিন ভবিষ্যত বিজ্ঞান মানুষকে শুধু বাইরের অগ্রগতির পথে এগিয়ে দেবে না। একই সঙ্গে তার মনের পৃথিবীও অনেকখানি বদলে যাবে। আজকের হিংসা লোভ স্বার্থপরতা ভুলে মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে।
শীর্ষেন্দুর গল্প তার চেনা পথে চারণ করে। তবু বারবার তার গল্পের কাছে আমাদের এসে বসতে হয় কেননা এই ছেলেমানুষের আশ্চর্য জগতের মধ্যে তিনি ভালো মানুষ মজার মানুষ এমনকি খারাপ মানুষকেও মিলিয়ে এমন এক পৃথিবীর গল্প বলেন যে পৃথিবীর অনেকটাই চেনা; আবার যে পৃথিবীতে আগামী দিনের বদলে যাওয়া মানুষের বিশ্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেই আনন্দময় বিশ্বের প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত মনকে ভারী প্রসন্ন করে তোলে।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Soma Mondal
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।