বইঃ পূর্ব-পশ্চিমে
লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রথমেই বলে রাখি এই উপন্যাসটিকে 'রেটিং' দেওয়ার মতো সাহস আমার নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বরাবরই আমার একজন পচ্ছন্দের লেখক।যেহেতু দিন-দুয়েক আগে উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম, সেহেতু এটি নিয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া দেব বলে মনস্থির করেছি।
পৃথিবী যেমন পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত, ঠিক একই ভাবে আমাদের প্রত্যেক মানুষের মনও পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত,এই উপন্যাসে তারই প্রতিফলন দেখতে পাই। যে চরিত্র ঘিরে পুরো উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে, যৌবন পর্ব অতিক্রম করে তা বৃদ্ধ হয়ে যেন আমাদের কাঁদিয়ে চলে যায়। প্রতাপ প্রথম থেকে কলকাতার অধিবাসী হলেও তার কিশোর বাংলায়। সেই আটচালা বাড়ি, আমগাছ, মাছের পুকুর। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, বাবুল মামন এরা স্মৃতিতেই থেকে গেলো। কিন্তু দিন শেষে প্রতাপের মতো আমিও চাইছিলাম সে দেশে ফিরতে।
এই লেখকের নায়িকারা বেশিরভাগ সময়ই তাদের মনের মানুষকে পাইনি, পেলেও তা অনেক কষ্টের ফসল। প্রতাপ-বুলা, অতিন-অলিদের দেখলেই তা বোঝা যায়।
পৃথিবীর পূর্ব পশ্চিমে যেমন ভাঙা-গড়ার খেলা চলে, মানুষের জীবনেও একই রকম ভাঙা-গড়া চলে। তবে এ উপন্যাসের পাঠিকা হিসাবে বলতে পারি, উপন্যাসটি এপার বাংলার মানুষের মনেও গভীর প্রলেপ লাগিয়ে যাবে, যা মানুষের মনের মণিকোঠায় অনেক দিন থেকে যাবে।
রিভিউটি লিখেছেনঃ tania das
পূর্ব-পশ্চিম
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বহুচর্চিত উপন্যাস "পূর্ব-পশ্চিম। প্রায় 2000 পৃষ্ঠার এক বিশাল ক্যানভাসে দেশভাগের পটভূমিকায় রচিত এই কালজয়ী উপন্যাস।
আক্ষরিক অর্থেই কালজয়ী। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভারতে রাজনৈতিক টালমাটাল, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, নক্সাল আন্দোলন, পাকিস্তান ভাগ, বাংলাদেশের জন্ম, উদ্বাস্তু সমস্যা, ফেলে আসা স্মৃতি, মন্বন্তর - এ সবই বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে এক জাজ্বল্যমান ক্ষত। ইতিহাসের বহুপঠিত এই অধ্যায়গুলো হয়তো নীরস সাল-তারিখের ভাঁজেই সীমাবদ্ধ থেকে যেত, যদি না এই উপন্যাসের সাথে পরিচয় হত। গৃহহারা, সহায় সম্বলহীন যে মানুষগুলো রাতের অন্ধকারে, আত্মীয়- বন্ধুদের রক্তে রাঙা রাস্তা পেরিয়ে আছড়ে পড়েছিল প্রতিবেশী দেশের বর্ডারে তাদের আর্ত চিৎকার কি আর ইতিহাস বইতে লেখা থাকে: রুমীর মায়ের মত আরও হাজার হাজার অসহায় মায়ের শুষ্ক চোখ যেন দাবি জানিয়েছিল এইরকম এক আখ্যানের। স্রেফ নীরস ঘটনাবলীর সম্ভার নয়, এ বই ভাবতে বাধ্য করে, বাধ্য করে আত্মবিশ্লেষণে।
ঘটনার সূত্রপাত প্রতাপ নামে এক হাকিমকে ঘিরে, অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন, সৎ, নির্ভীক মধ্যবয়সী এই মানুষটি দেশভাগের আগেই বাংলাদেশের মালখানগর এর পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। না, তখনও অবশ্য বাংলাদেশ ভূমিষ্ট হয়নি। সেই হিসেবে প্রতাপ কোনোভাবেই রিফিউজি নন। তবুও এ দেশের সাথে (ত্রিখন্ডিত ভারতের সাথে) তিনি কি কখনো একাত্ম হতে পেরেছিলেন? পদে পদে তাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে ধর্মের, দেশ বিভাগের এক অদৃশ্য
কাঁটাতারের, যে কাঁটাতার ছিন্নভিন্ন করে দেয় প্রতাপের নিষ্কলুষ শৈশব, সুপ্রীতির সুখের সংসার, মামুনের স্বপ্ন, হারীত মণ্ডলের মাটির পুতুল, মঞ্জু - বাবুলের নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপ, সর্বোপরি লাখ লাখ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার।
দেশভাগ ও তার সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে হয়তো বাংলা সাহিত্যে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে, কিন্তু এমন ত্রিমাত্রিক মডেলে তাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা প্রায় দুর্লভ। পূর্ব-পশ্চিম এই শব্দবন্ধ তো শুধুমাত্র ভারত- পাকিস্তান, পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ বা হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ককে তুলে ধরে না, তুলে ধরে দুই গোলার্ধকেও।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র অতীনসহ অনেকেই এই তীব্র আগুনের আঁচ থেকে বাঁচতে পাশ্চাত্যে পাড়ি দেয়। আমেরিকা, লন্ডনের সাথে ভারতের বা প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক দূরত্বও এই উপন্যাসের অন্যতম উপজীব্য।
এই সুবিস্তৃত উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া দেওয়া তাই আমার পক্ষে হয়তো ধৃষ্টতা। তবুও বইটি শেষ করার পর মনখারাপের একটা রেশ থেকে যায়, যে মনখারাপের ব্যথা প্রতাপ বহন করেছিল চিরকাল। মাত্র পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে এশীয় মানচিত্র যে নিষঠুর দলাদলি দেখেছিল, তা থেকে কি আমরা কোন শিক্ষাই নেব না? নাকি Rudyard Kipling এর মত আমরাও ধরেই নেব East is Gast and West is West, and never the twain shall meet?
হয়তো এই প্রশ্নই জ্বলজ্বল করতে থাকে উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায়....
রিভিউটি লিখেছেনঃ Sharbar
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।