কলকাতার কসবি কিস্যা
লেখক - দেবযানী ভট্টাচাৰ্য
আখরকথা প্রকাশন
মির্জা গালিব শুধু একজন অসামান্য শায়েরই নন এক অনবদ্য পত্রলেখকও ছিলেন, উনি ওনার একটা চিঠি তে বলছেন।
"হামনে ওহ আন্দাজ-এ-তাহরির ইজাদ কিয়া হ্যায় কে মুরাসলে কো মুকালমা বানা দিয়া হ্যায়"
(আমি এমন এক লেখার ভঙ্গী আবিষ্কার করেছি যে, লিখিত ভাষাকে কথোপকথন বানিয়ে দিয়েছি)।
এই বইটা পড়তে পড়তে বারবার এই কথাগুলো মনে পড়ছিলো, এক আশ্চর্য হিরণ্ময় গদ্যে এই বই লেখা; মনে হবে সামনে বসে কেউ বলছে গল্পটা।
আলোচনা এগোনোর আগে প্রথমেই বলতে চাই এই বইটার নামকরণ নিয়ে।
কী অসামান্য অনুপ্রাসের প্রয়োগ।' ক' দিয়ে শুরু শব্দত্রয়ীর এই প্রয়োগে আমি অন্তত কাৎ, আর তাছাড়াও এই নামকরণ উস্কে দেয় বইটা হাতে নিয়ে উল্টে দেখার ইচ্ছে।
এরকম আমার আরেকবার মনে হয়েছিল 'No One Writes to Colonel" এর নামকরণ দেখে।
যদিও দুটি বই সবদিক থেকেই সম্পূর্ণ আলাদা, আমি শুধু কৌতূহল উস্কে দেওয়ার বিষয়ে উল্লেখ করলাম আরেকটি নাম।
এই বই আসলে ইতিহাসের খনি কিন্তু নিরস নয়, বরং বলার থুড়ি লেখার প্রসাদগুণে হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সরস।
এই বইটা পড়ে যে আমি কতো কী জেনেছি তার ইয়ত্তা নেই, গুপ্তাচর বৃত্তি থেকে প্রশাসনের স্তম্ভ, কসবিরা যে কতো বিচিত্রকর্মা ছিলেন যুগে যুগে সেটা এই বই না পড়লে জানাই হতো না।
কেউ কেউ বলতেই পারেন যে এই তথ্যগুলো আগেই জানা, আপত্তি করবোনা, আসলে দু মলাটের ভেতরে কসবি বিষয়ক এরকম তথ্যভান্ডার আমি আগে দেখিনি, এটাই এই বইটার USP।
এই বইটির আরেকটি সম্পদ হলো এর ভাষা, আশ্চর্যরকমের দেদীপ্যমান ভাষা, এরকম নিয়ন্ত্রিত কিন্তু সুললিত গদ্য আজকাল বড়ো একটা দেখিনা এবং পাঠকদের অনুরোধ করবো এর মুখবন্ধটা পড়তে, অনেকদিন বাদে কোনো সাম্প্রতিক বইয়ের মুখবন্ধ পড়ে এতো ভালো লাগলো।
আরেকটা অসামান্য বিষয় আছে এই বইটির ভাষায়, কাল সাপেক্ষে ভাষা তার চলন পাল্টেছে, অর্থাৎ মোগল আমলের কথা বলতে গিয়ে লেখক উর্দু, ফার্সি শব্দবহুল এক ভাষার ব্যবহার করেছেন আবার সাহেবী আমলের কথা বলতে গিয়ে হুতোম কে গুরু মেনেছেন, অর্থাৎ কালানুসারী ভাষা, অসম্ভব শক্ত বিষয় কিন্তু লেখক এই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
এই বই পড়তে পড়তে আরেকটা অনুভূতি হলো সেটা হলো যে কসবি অর্থাৎ গণিকাদের নিয়ে আলোচনা মানেই আমাদের একটা মধ্যবিত্ত বিপন্নতা আর পাপবোধ কাজ করে, লেখক কিন্তু তার বাইরে গিয়ে একদল মানুষ হিসাবে ওনাদের তুলে ধরেছেন।
এবং কোথাও যেন উনি সমাজের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে একটা মাতৃমূর্তির নির্মাণের চেষ্টা করেছেন।
হয়তো তাঁরা সভ্যসমাজের যোনীসম্ভুতা নয় বলে আমরা ভাবতে ভালোবাসি কিন্তু তাঁরা আসলে আমাদের রিপুতাড়িত, ইন্দ্রিয়াসক্ত সমাজেরই একটা অংশ।
ঋত্বিক ঘটক তাঁর "মেঘে ঢাকা তারা" তে দেখিয়েছিলেন যে আমাদের অবহেলনের দ্বারা যে মাতৃপ্রতিমার হত্যা করেছিলাম তার পাপ আজও আমরা বয়ে চলেছি।
ইডিপাস অজান্তেই মাতৃসঙ্গম করেছিলো তার জন্য সে মূল্য চুকিয়েছে কিন্ত ঋত্বিকের বিশ্বে আমরা যে অনিঃশেষ নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েছি সেখান থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
এই বইয়েও আমরা আসলে এক মৃত সংস্কৃতির শবানুগমন করেছি লেখকের সাথে, এক হারানো সময়ের।
এবং আমাদের বর্তমান মেরুদন্ডহীন সমাজের এ যেন নতুন পাপসংহিতা, কারণ নাৰ্যযত্র পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Susanta
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।