আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় Ananda Math by Bankim Chandra Chatterjee

আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় Ananda Math by Bankim Chandra Chatterjee

আনন্দমঠ
     বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
 

আমার মতো একজনের জন্য এই উপন্যাসের সম্বন্ধে আলোচনা করতে যাওয়া ধৃষ্টামি হবে। বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম প্রধান সম্পদ এটি। 

চিরবিখ্যাত এই উপন্যাসের সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলতে গেলে হাসির পাত্র হব আমি। তবুও বলি এই উপন্যাস নিয়ে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় দিক থেকে অনেক বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু কেন সেটা উপন্যাস পড়তে গিয়ে বুঝতে পারলাম। 

যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে ততদিন এই উপন্যাসের নাম প্রথম সারিতে চিরউজ্জল হয়ে থাকবে, Shakespeare এর ভাষায়  "As long as men can breath or eyes Can see So long lives this...."

রিভিউটি লিখেছেনঃ KศມຮнḯK 🇮🇳


আনন্দমঠ : ইতিহাসকে মুছে ফেলবার একটি প্রচেষ্টা 

ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ভারতের জনসাধারণের প্রথম বিদ্রোহ আরম্ভ হয় ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে। বাংলাদেশ ও বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রায় ৩৭ বছর ব্যাপী অর্থাৎ ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হওয়া এই বিদ্রোহকে ইতিহাসবেত্তারা 'সন্ন্যাস বিদ্রোহ' নামে অভিহিত করেন।

মূলত সম্মিলিত হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম মাদারী এবং ধার্মিক ফকিরদের বৃহৎ গোষ্ঠী যারা পবিত্রস্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারত থেকে বাংলার বিভিন্নস্থান ভ্রমণ করতেন তাঁরাই ছিলেন এই বিদ্রোহের মুল কারিগর। তীর্থস্থানে যাওয়ার পথে এসব সন্ন্যাসীগণ গোত্রপ্রধান এবং জমিদারদের কাছ থেকে ধর্মীয় অনুদান গ্রহণ করতেন যা তখন রেওয়াজ হিসেবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দেওয়ানী লাভ করে তখন থেকে অনুদান দেওয়া তো দুর অস্ত বরং তারা তীর্থযাত্রীদের মাথাপিছু বিভিন্ন প্রকারের কর ধার্য করে প্রবল শোষণ আরম্ভ করে। সমসাময়িক ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে মোগল শাসনের শেষভাগে ভারতের বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় বিভিন্ন অ‍ঞ্চলে জমিজমা দখল করে অথবা শাসকদের নিকট হতে দান হিসাবে লাভ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন এবং চাষবাস করে রীতিমত কৃষকে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু তা হলেও ইহারা সন্ন্যাসী ও ফকিরের পোষাকই পরিধান করতেন এবং চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বছরের বিভিন্ন সময়ে দল বেঁধে তীর্থ ভ্রমণে বার হতেন। ইংরেজ শাসনের প্রথম থেকেই অন্যান্য কৃষকদের সাথে সাথে এঁরাও ব্যাপক শোষণের শিকার হন। ১৭৭১ সালে, ব্রিটিশ শাসক দ্বারা ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয় দৃশ্যত বিনা কারণে। উপরন্তু ফসলহানি, ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দের মহাদুর্ভিক্ষ, যা ইতিহাসে 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' নামে খ্যাত হয়ে আছে, যাহাতে প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় যা তৎকালীন বাংলার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এবং লক্ষ লক্ষ মুমুর্ষু মানুষ শিয়ালকুকুরের খাদ্যে পরিণত হয়, সমস্যাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয় কারণ আবাদী জমির বেশিরভাগ থেকে যায় ফসলশূণ্য। উপরোক্ত বিভিন্ন কারনে শোষক ইংরেজদের প্রতি ক্ষোভের মাত্রা চরমে ওঠে এবং সশস্ত্র সন্ন্যাস বিদ্রোহের মাধ্যমে ফেটে পড়ে। 

বিদ্রোহী বাহিনী ও বিদ্রোহের নায়কগণ যে অঞ্চলেই গিয়েছিলেন সেই অঞ্চলেরই জমিহারা গৃহহারা কৃষকগণ তাদের সকল শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এমনকি ক্রমধ্বংসপ্রাপ্ত মোগল সাম্রাজ্যের ছত্রভঙ্গ বেকার সৈন্যদের একাংশও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগদান করেন। এই বিদ্রোহী সন্ন্যাসী ও ফকিরদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভবাণী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, মজনু শাহ, কৃপানাথ, রামানন্দ গোঁসাই, মুশা শাহ ইত্যাদিদের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথমোক্ত দুজনকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসের মাধ্যমে স্মরণীয় করে গিয়েছেন যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ অনেকের মতে আনন্দমঠ উপন্যাস তথ্যবিকৃতির দায়ে অভিযুক্ত। বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দের মধ্যে তৃতীয়জন অর্থাৎ বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে যাওয়া মজনু শাহ বা মজনু ফকির আনন্দমঠে সম্পূর্ণ ব্রাত্য।

এবার আসা যাক আনন্দমঠ উপন্যাসের কথায়। নিজের 'প্রথম আলো' উপন্যাসে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসটিকে তথ্য পরিবর্তনের (তথ্যবিকৃতিও নয় কি?) দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সন্ন্যাস বিদ্রোহের কাহিনী নিয়ে লিখিত আনন্দমঠ উপন্যাস এবং বন্দেমাতরম গান যতোই জাতীয়তাবাদীদের উদ্বুদ্ধ করুক না কেন, মনে রাখতে হবে, বঙ্কিমচন্দ্র কিভাবে আনন্দমঠের দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে বারবার এর পাঠ বদল করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে এটি আদৌ ইংরেজবিরোধী উপন্যাস নয়। 

বঙ্গদর্শনের সপ্তম বছরে অর্থাৎ ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যা (বঙ্গদর্শনের ৮৪ তম সংখ্যা) থেকে ধারাবাহিকভাবে বঙ্কিমচন্দ্র লিখিত আনন্দমঠ উপন্যাস প্রথমবার প্রকাশিত হয়। সেই ধারাবাহিক উপন্যাস সিরিজ আর পরবর্তীকালে প্রকাশিত আনন্দমঠ উপন্যাসের পুর্ণাঙ্গ সংস্করণ পড়লে দেখা যায় কিভাবে 'ইংরেজসেনা' 'যবনসেনা'-তে এবং 'ইংরেজ' কখনও 'যবন'-এ কখনও 'নেড়ে'-তে পরিবর্তিত হয়েছে। 

এর জন্য আমাদের চলে যেতে হবে সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলীর অন্তর্গত পরিমার্জন করা আনন্দমঠ উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের একাদশ পরিচ্ছেদের অংশবিশেষে। অংশটিতে লেখা আছে, 

"একা ভবানন্দ কুড়ি জন সন্তানের সাহায্যে সেই এক কামানের বহুতর সেনা নিহত করিতে লাগিলেন – কিন্তু যবনসেনা জলোচ্ছ্বাসোত্থিত তরঙ্গের ন্যায় ! তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ ! – ভবানন্দকে সংবেষ্টিত, উৎপীড়িত, নিমগ্নের ন্যায় করিয়া তুলিল। ভবানন্দ অশ্রান্ত, অজেয়, নির্ভীক – কামানের শব্দে শব্দে কতই সেনা বিনষ্ট করিতে লাগিলেন। যবন বাত্যাপীড়িত তরঙ্গাভিঘাতের ন্যায় তাঁহার উপর আক্রমণ করিতে লাগিল, কিন্তু কুড়ি জন সন্তান, তোপ লইয়া পুলের মুখ বন্ধ করিয়া রহিল। তাহারা মরিয়াও মরে না – যবন পুলে ঢুকিতে পায় না।"

এবার দেখা যাক ১২৮৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে বঙ্গদর্শনের ৯০ তম সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত আনন্দমঠ উপন্যাসের একই পরিচ্ছেদের একই অংশ। (১নং স্ক্রীনশট দ্রষ্টব্য) দুটি অংশ তুলনা করলে বুঝবেন কেমন "ইংরেজসেনা" "যবনসেনা"-তে এবং "ইংরেজ" রূপ পরিবর্তিত হয়ে "যবন"-এ পরিবর্তিত হয়েছে। 

এবার ওই একই পরিচ্ছেদের পরবর্তী অনুচ্ছেদ দেখুন।

"ভবানন্দ রঙ্গ দেখিতেছিলেন। ভবানন্দ বলিলেন, 'ভাই, নেড়ে ভাঙ্গিতেছে, চল একবার উহাদিগকে আক্রমণ কর।' তখন পিপীলিকাস্রোতবৎ সন্তানের দল নূতন উৎসাহে পুল পারে ফিরিয়া আসিয়া যবনদিগকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল। অকস্মাৎ তাহারা যবনের উপর পড়িল। যবন যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল না – যেমন ভাগীরথীতরঙ্গ সেই দম্ভকারী বৃহৎ পর্বতাকার মত্ত হস্তীকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সন্তানেরা তেমনি যবনদিগকে ভাসাইয়া লইয়া চলিল। যবনেরা দেখিল, পিছনে ভবানন্দের পদাতিক সেনা, সম্মুখে মহেন্দ্রের কামান।"

এবার দেখা যাক বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমচন্দ্র কি লিখেছিলেন। (২নং স্ক্রীনশট দ্রষ্টব্য) এক্ষেত্রেও বঙ্গদর্শনে লিখিত "ইংরেজ" পরিবর্ধিত হয়েছিল কখনও "নেড়ে" আবার কখনও বা "যবন"-এ এবং "ইংরেজদিগকে" পালটে হল "যবনদিগকে"। 

এই শেষ নয় ! ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত আনন্দমঠের তৃতীয় খণ্ডের ষোড়শ পরিচ্ছেদ, যা পরিমার্জিত উপন্যাসের চতুর্থ খণ্ডের চতুর্থ পরিচ্ছেদ - সেখানেও একইরকমের খোদকারি করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। প্রথম দেখুন বঙ্কিম রচনাবলীতে কি আছে।

"উত্তর বাঙ্গালা মুসলমানের হাতছাড়া হইয়াছে। মুসলমান কেহই এ কথা মানেন না – মনকে চোখ ঠারেন – বলেন, কতকগুলি লুঠেড়াতে বড় দৌরাত্ম্য করিতেছে – শাসন করিতেছি।"

এবার বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত উপন্যাসের ওই অংশটি পড়ুন। (৩নং স্ক্রীনশট দ্রষ্টব্য) দু-দুবার "ইংরেজ" শব্দটাই পরিমার্জিত উপন্যাসে বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে !

একই ভাবে পরিমার্জিত উপন্যাসের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের অংশবিশেষ যেখানে লেখা আছে, "বল হরে মুরারে ! হরে মুরারে ! উঠ ! মুসলমানের বুকে পিঠে চাপিয়া মার ! লক্ষ সন্তান টিলার পিঠে।” বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত অংশটির সঙ্গে তুলনা করলে (৪নং স্ক্রীনশট দ্রষ্টব্য) দেখবেন আবার ওই ভাষাবদল। এ ক্ষেত্রেও পরিমার্জিত উপন্যাসে "ইংরেজ" উধাও !

বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজ রাজকর্মচারী ছিলেন। আনন্দমঠের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের ধাতানি খান তিনি। যতদূর জানি বঙ্কিমকে সতর্ক করে উড়িষ্যাতে বদলীও করে দেওয়া হয়। এখন আর্থিক স্বাচ্ছন্দের জন‍্য, সামাজিক আভিজাত‍্য বজায় রাখার জন‍্য ঐ চাকরী তাঁর দরকার ছিল, তাই আনন্দমঠের পরবর্তী সংস্করণে ইংরেজ বিরোধী শব্দ মুছতে বাধ‍্য হন তিনি। কিন্তু চারিত্রিক সততা থাকলে, মনের মধ্য লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক মনোভাব না থাকলে তিনি তো নীরব প্রতিবাদ করে উপন্যাসটির প্রকাশ বন্ধ করে দিলেই পারতেন। তা না করে, ইংরেজ শব্দের বদলে যবন মুসলমান বা নেড়ে শব্দ বঙ্কিমচন্দ্র কেন বসালেন? এইভাবে ব্রিটিশবিরোধী উপন্যাস থেকে আনন্দমঠ না কেবল ধাপে ধাপে একটি আদ্যন্ত মুসলিমবিরোধী উপন্যাসেই পরিবর্তিত হল, সন্ন্যাস বিদ্রোহের আসল ইতিহাসটিকে সম্পূর্ণরূপে গুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র।

রিভিউটি লিখেছেনঃ শিবাশীষ বসু

Post a Comment

0 Comments