সাদা কাক : স্বপ্নময় চক্রবর্তী Sada Kak by Swapnamoy Chakraborty

সাদা কাক : স্বপ্নময় চক্রবর্তী Sada Kak by Swapnamoy Chakraborty

বইয়ের নাম: সাদা কাক
লেখক: স্বপ্নময় চক্রবর্তী
প্রকাশনী: দে'জ পাবলিশিং
মূল্য: 350 

প্রত্যেকটি গল্প মোটে ৩ পাতা। ৩ পাতার গল্প গুলোতে সাধারণ মানুষের গল্প আছে সাথে sarcasm, কোনোটার শেষ দুঃখের কোনোটার আমোদের, কোনোটা অন্য রকম। কিন্তু বেশ ভালো। হয়তো আমাদের প্রতিদিনের জীবনেই এরকম কিছু চরিত্র দেখে থাকি আমরা। আগে লেখক এগুলো আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাৎসরীয়তে লিখতেন। পরে এগুলো নিয়ে বই প্রকাশ করেন। খুবই ভালো লেগেছে আমার, শর্ট স্টোরি লাভারদের ভালো লাগবে আশা করি। এখানের একটা গল্পের মতো গল্প "আকাশ অংশত মেঘলা" সিনেমায় দেখেছিলাম। জানি না কাকতলীয় নাকি এখান থেকে নেওয়া। যাই হোক।

রিভিউটি লিখেছেনঃ নন্দিনী বিশ্বাস

'সাদা কাক' থেকে ....
স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আমি প্রথম আই-ব্রাও স্টিক দেখেছিলাম কোনও মহিলার ড্রেসিং টেবিলে নয়, সিগারেটের প্যাকেটে। লাল্টুদার চারমিনারের প্যাকেটে কালো সিগারেট দেখে অবাক হই। উনি বুঝিয়ে বলেন ওটা কী বস্তু। উনি ফাংশনের ঘোষক ছিলেন। স্টেজে ওঠার আগে একটা মেক-আপ নিতে হত।
তখন জলসা হত। মানবেন্দ্র, শ্যামল মিত্র, বেচু দত্ত, পিন্টু ভট্টাচার্য, উৎপলা, প্রতিমা। মিন্টু দাশগুপ্ত, দীপেন মুখোপাধ্যায় প্যারডি গাইতেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা জহর রায়ের কমিক মানে ভলান্টিয়ারদের দফারফা। যন্ত্রসংগীতও থাকত। ইলেকট্রিক গিটারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব নাম করেছিলেন। ভি বালসারার বাজনাও শুনেছি। এই সব জলসায় ঘোষকদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। অজয় বিশ্বাস, সুশান্ত ঘোষ-রা রেডিয়োর ঘোষণার ছকের বাইরে অন্য ধারা শুরু করেছিলেন পরে ওই ধারা ফুলে-ফলে পল্লবিত হতে থাকে।
আমাদের পাড়ার লাল্টুদা পল্লবিত ঘরানার ঘোষক। বেশ নামডাক হয়েছিল। নামডাক হলেই ডাকনামেই বিখ্যাত হন ওঁরা। যেমন বুড়ো রায়, তোচন ঘোষ...। লাল্টুদাও লাল্টু মিত্র নামেই বিখ্যাত ছিলেন এবং আমাদের পরম সৌভাগ্য যে মাঝে মাঝে মুখার্জিপাড়ার রোয়াকে আমাদের মধ্যে বিরাজিত হতেন।
বায়না করতাম, লাল্টুদা, একটু ঘোষণা শোনাও না...। উনি গলা খাঁকারি দিয়ে বলতেন নে, এটা হল মান্না দে-র ঘোষণা।
বন্ধুগণ, আকাশ নীল। সমুদ্রও নীল। নীলে নীলে নীলাকার। সমুদ্রের আছে ঢেউ, গানের আছে সুর। সুরে সুরে সুরাকার। আস্তে, আস্তে, আস্তে। আজ সুরের সাগরে ময়ূরপঙ্খি বেয়ে আসছেন আমাদের...
হঠাৎ ‘আস্তে আস্তে আস্তে’ বললেন কেন, জিজ্ঞাসা করায় লাল্টুদা বলেছিলেন, আরে, ওটা তো স্ক্রিপ্টের মধ্যেই থাকে। সুরে সুরে সুরাকার বললেই পাবলিক খুব হাততালি মারে কিনা, তখন আমায় বলতে হয় ‘আস্তে আস্তে আস্তে’। হাততালি থেমে গেলে বাকিটা বলি।আসছেন আমাদের পরম প্রার্থিত, পরম কাঙ্ক্ষিত এক শিল্পী যাঁর নাম আমাদের হৃদয়ে। কাগজে নয়, কারণ, কাগজ ছিঁড়ে যায়। পাথরে নয়, কারণ, পাথর ক্ষয়ে যায়। হৃদয়ে লেখা নাম থেকে যায়। পথের কাঁটায় রক্ত ঝরিয়ে এই মায়াবী সন্ধ্যায়, এই ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে, আমাদের সামনে আসছেন...
হাত তুলে কয়েক সেকেন্ড স্ট্যাচু। তার পর লাল্টুুদা বললেন, মা-ন্-ন্-না দে-এ-এ-এ। আস্তে আস্তে আস্তে। 
লাল্টুুুদা বলতেন, আরে, ঘোষণা একটা আর্ট। রেডিয়ো মার্কা ঘোষণা কি মাচায় চলে? পাবলিককে এমন দোবো যে গান না শুনে শুধু ঘোষণাই শুনবে।
এক বার একটা ফাংশনের অ্যারেঞ্জাররা আমাকে বলল, বাঁচান। শ্যামল মিত্র আসতে পারবেন না। পাবলিক শ্যামল মিত্রের নামেই সব এসেছে। বাকিরা তো সব কিশোরকণ্ঠী, হেমন্তকণ্ঠী। শুধু শ্যামল মিত্রই অরিজিনাল ছিল। বললাম, ম্যানেজ করে দেব।
পাড়ার চম্পা-টেঁপি-বুঁচিদের গান হয়ে যাওয়ার পর দু-একটা কণ্ঠী ধরিয়ে দিলাম। মাঝখানে বলতে থাকলাম: সবার শেষে থাকছে ‘যা গেছে তা যাক’-খ্যাত, ‘নাম রেখেছি বনলতা’-খ্যাত, ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব-নিকাশ’-খ্যাত শ্যামল মিত্র।
একটা করে টেঁপি-বুঁচিদের গান হচ্ছে আর আমি ওই লাইনটা রিপিট করছি জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব-নিকাশ, কিছুই রবে না। লাস্টের দিকে চলে এলাম। আমি মাইকের সামনে গিয়ে গেয়ে দিলাম
সে তো এল না।/ এল না/ কেন এল না/ জানি না।
হারাল কী আঁধারেতে/ নিভে গেল দীপ যে/ কেন জানি না।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, শ্যামল মিত্র আসতে পারলেন না। সে এল না। কিন্তু কেন এল না, সেটা জানি। গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে মাঝপথে। আমাদের লোক ট্যাক্সি নিয়ে ছুটল, কিন্তু তত ক্ষণে তিনি অন্য একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। কেন গেলেন? এত জানা, তবু আজও মন তাঁর জানা গেল না। কিন্তু ভাই, জীবনে কি সব চাওয়া পাওয়া মেলে? জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব-নিকাশ, কিছুই রবে না। তার পরে শ্যামলদার ‘যা গেছে তা যাক’ গানটার লিরিক বলে দিলাম। হাততালি। আর তখনই ‘আস্তে-আস্তে-আস্তে।’ 
লাল্টুদা ক্রমশ বিখ্যাত হয়ে উঠতে লাগলেন। ক্রমশ কবিও হতে লাগলেন। অটোগ্রাফে পদ্য লিখতে শুরু করলেন। তোমার নাম? সুমিতা? হও আমার মিতা। তার পর কায়দা করে সই। তুমি কে? হৈমন্তী? হও আমার পয়মন্তি। সুলেখা? হয় যেন আবার দেখা। এক বালিকা বলেছিল, আমার মাসির জন্য একটা দিন। অটোগ্রাফ-ব্যস্ত লাল্টুুুদা লিখে দিয়েছিলেন মাসি, কী সুন্দর তোমার হাসি!
এক বার দেখি, বাঁ গালটা এবং উপরের ঠোঁটটা খুব ফোলা।
কী হয়েছে লাল্টুদা?
অটোগ্রাফের বিপদ। একটা অটোগ্রাফ দিতে হল। নাম বলল মিনতি দত্ত। যা-তা ব্যাপার। পেন-কিলার খাচ্ছি এখন।
কেন? পেন-কিলার কেন? দত্তর সঙ্গে মেলানোর জন্য গর্ত ছাড়া আর কিছু মনে পড়েনি যে তখন...।

Post a Comment

0 Comments