বই - লেখায় শিব্রাম রেখায় শ্রীশৈল
লেখক - শিবরাম চক্রবর্তী
প্রকাশক - বুক ফার্ম
প্রথম প্রকাশ - জুন ২০২০
প্রচ্ছদ - স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
অলংকরণ - শৈল চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য - ২৫০/- (১ম) / ৩৪৫ /- ( ২য় )
"একদিন শিবরাম আর চন্ডী লাহিড়ী হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে। রাস্তার ধারে একজন বসে আছেন মাংসের ঘুগনি নিয়ে। অসাধারণ বানায়। শিবরাম গিয়েই তিনপ্লেট ঘুগনির অর্ডার দিলেন। একটা নিজে নিয়ে, অন্যটা চণ্ডীকে দিয়ে আর একটা এগিয়ে দিলেন স্বয়ং ঘুগনিওয়ালার দিকে...বললেন "তুমি এত ভাল ঘুগনি বানাও, অথচ নিজে খেয়ে দেখনা কত ভাল। সবই তো বেচে দাও। আজ নিজের ঘুগনি খেয়ে দেখ। কী অপূর্ব তোমার রান্না..."
সন্তোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারে গিয়ে গোবিন্দকে বলছেন "ভাজা নোনতা কী হবে রে?" গোবিন্দ বললে "রাধাবল্লভী গরম নেমেছে। টাকায় চারটে। তরকারি ফ্রি"
শিবরাম অর্ডার দিলেন "আমায় তবে একপ্লেট তরকারী দে। ওটা তো ফ্রি বললি"
একবার বিভূতিভূষণ আর শিবরাম গেছেন সাহিত্যসভায়। দুজনকেই বিরাট বড় দুটো স্মারক দেওয়া হল। শিবরাম নিতে নারাজ। বিভূতি বললেন "নিয়ে নাও এটা। নইলে ওঁরা দুঃখ পাবেন। আমি ঘোড়ার গাড়ি করে তোমায় পৌছে দেব"
শিব্রাম বললেন "তাতে মেলা টাকা যাবে যে"
"সে টাকা পরে চেয়ে নেব"
তারপর থেকেই বিভূতিভূষণের সঙ্গে দেখা হলেই শিবরাম বলেন "চলুন বিভুতিদা, পুঁটিরামের কচুরী খাই।"ভয় পাছে টাকা চেয়ে বসেন। পরে শিবরাম নিজেই স্বীকার করেছেন"যা কচুরি খাইয়েছি তাতে ঘোড়ার গাড়ির ভাড়ার অনেক বেশি খরচ করেছি"
আরও কত্ত গল্প তাঁকে নিয়ে।আরও কত্ত শত গপ্প তাঁর নিজের লেখা।
জীবনের শেষদিকে। এক শ্রাদ্ধবাসরে তার সঙ্গে দেখা হল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের। একথা সেকথার পর অচিন্ত্য বেশ দুঃখ করেই বললেন "ভাই কবে আছি কবে নেই। এর পর হয়তো তোমার আমার পরলোকেই দেখা হবে। শিবরাম বললেন "ক্ষেপেছ? পরপারে গিয়ে তোমার ওই কালো মুখ আমি খোঁজ করব! আমি তো খুঁজব সুচিত্রা সেনকে"।
তাঁর সম্পর্কে নানা গুণীজন বলেছেন নানা কথা। সবই হাস্যরসে ভরপুর। তিনি নিজেও তো সারাজীবন নিজেকে নিয়ে করে গিয়েছেন বিবিধ কৌতুক। তাই তো তিনি হাসির রাজা, রসময় - শিবরাম চক্রবর্তী। যিনি নিজের নাম জিজ্ঞাসা করলে বলতেন - শিব্রাম চক্কত্তি । এই প্রসঙ্গে একবার শ্রীযুক্ত ননীগোপাল চক্রবর্তী বলেছিলেন
- গোপাল নামে এক ভদ্রলোক শিবরামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা আপনি শিবরামকে শিব্রাম না লিখে শিবর্যাম লিখলেই তো পারতেন।
শিবরাম উত্তর দিলেন, তাহলে যে গোপালের সঙ্গে ভ্যা ভ্যা করে বেড়াতে হত।
আজ এই হাসির রাজার জন্মদিন। যিনি চিরকাল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে হাসিয়ে গেছেন। নিজের দুঃখী দরিদ্র জীবনের যাবতীয় গ্লানি কষ্ট লুকিয়ে রেখে, মৃত্যুর পর যাঁকে খুঁজে পাওয়া গেছিল শীতলতায় ঢাকা বরফঘরের এক টুকরো ড্রয়ারের ভিতর।সেই হিম শীতল বাক্সেও যার মুখে লেপটে ছিল এক টুকরো হাসি। যে রিনিকে তিনি আকুল হয়ে ভালোবেসেছিলেন, সেই রিনিও একদিন হঠাৎ তাঁকে ভাইফোঁটা দিয়ে অন্যের স্ত্রী হয়ে সংসারী হন। হাসির রাজা চরম ব্যর্থতা ও দুঃখের মাঝেও তাই নিয়ে মজা করতে পিছপা হন না। যদিও আমৃত্যু রয়ে যান অবিবাহিত। আজ তাঁর জন্মদিন।তাঁর জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁরই লেখা কিছু রচনা দিয়ে সাজানো বই " লেখায় শিব্রাম রেখায় শ্রীশৈল" ।
এই বইয়ে শিবরাম চক্রবর্তীর সাথে আছেন বিখ্যাত শিল্পী শ্রী শৈল চক্রবর্তীর কথাও। যাঁর আঁকা ছাড়া শিবরামের লেখা অনেকাংশেই অসম্পূর্ণ। এই শিল্পীর কলমের আঁচড়েই ফুটে উঠেছিল শিবরামের বিখ্যাত সমস্ত ঘটনাবলী সহ সকল চরিত্ররা।হর্ষবর্ধন - গোবর্ধনকে আমরা যে কল্পনাই করতে পারতামনা যদি না শৈল চক্রবর্তী তাঁদের তুলির টানে অবয়ব দান করতেন। এই বইয়ে বেশ কয়েকটি গল্প আছে শিবরাম চক্রবর্তী লিখিত। সাথে আছে শৈল চক্রবর্তীর আঁকা অনবদ্য সমস্ত আঁকা বা ইলাস্ট্রেশন। আছে শিবরাম সম্পর্কিত অজানা বহু তথ্য।
বইয়ের দুই স্বনামধন্যের সম্পর্কে মুখবন্ধ লিখেছেন শৈল চক্রবর্তীর কন্যা নমিতা চক্রবর্তী ও পুত্র দীপক চক্রবর্তী ( অভিনেতা ও চিত্রশিল্পী চিরঞ্জিত)। এই লেখা থেকেও একজন পিতার সম্পর্কে ও একজন শিল্পীর সম্পর্কে অনেক অজানা কাহিনী পাঠক জানতে পারেন।
বইটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত। দ্বিতীয় খণ্ডটি সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম খণ্ডটি আমি পড়েছি। সেই বই নিয়েই আজ লিখছি। প্রথম খণ্ডে গল্প ও চিত্রাঙ্কনের সাথে আছে বিখ্যাত গুণীজনদের স্মৃতিচারণা সমূহ। যা বইটিকে অসাধারনত্ব দান করেছে। পারলে অবশ্যই পড়বেন বইদুটি। এই দুই মহান শিল্পীকে স্মরণ করে এই সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য আমার পক্ষ থেকে নিবেদন করলাম।
ভালো থাকুন। পড়তে থাকুন।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Sanjhbati
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।