বই: কাছের মানুষ
লেখিকা: সুচিত্রা ভট্টাচার্য
"মানুষ তো চিরকালই নিঃসঙ্গ। কি ভিড়ে,কি নির্জনে।নিজের চারিদিকে প্রিয়জনের বলয় সৃষ্টি করে বৃথাই সেই নিসঙ্গতা ঘোচাতে চায় মানুষ। হায় রে মানুষ!"
যখন প্রথম এই দীর্ঘ উপন্যাস শুরু করেছিলাম টান পাচ্ছিলাম না একটুও, তারপর পড়তে পড়তে ঘটনাপ্রবাহ এগোতে থাকে, খুলে যেতে থাকে একের পর এক স্তর, উন্মোচিত হতে থাকে কিছু লুকিয়ে রাখা সত্যির, মুখোমুখি হতে হয় কঠিন আর রূঢ় বাস্তবের।
পরিবার, আত্নীয় স্বজন! কতশত বন্ধন, তাদের ঘিরে কতো সম্পর্কের মারপ্যাচ। এতোকিছুর ভীড়েও যে প্রতিটি মানুষ গভীরভাবে সম্পর্কহীন, বড্ড একা। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের 'কাছের মানুষ' উপন্যাস যেন তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তিতির, ইন্দ্রাণী, শুভাশিস, আদিত্য, সুকান্ত, জয়মোহন, শিবসুন্দর, টোটো, জয়ী, শংকর, ছন্দা, তনুময় আরও কতো চরিত্রের সমাহারে লেখিকা ফুটিয়ে তুলেছেন একান্নবর্তী সংসারের ভাঙ্গন, চাকরিসূত্রে বাইরে চলে যাওয়ার ফলে মা-ছেলের মধ্যে বেড়ে চলা দূরত্ব, বন্ধুত্বের ভাঙন, বোঝাপড়া,গ্রাম জীবনের সরলতা ও রাজনীতি, তারই মধ্যে এক উন্নতশীর বৃদ্ধ ডাক্তারের জীবনযাপন, কিশোর বয়েসের মান-অভিমান, ভালোবাসার লুকোচুরি, সফল মানুষের গোপন ব্যর্থতার কাহিনী, বিফল মানুষের সফল না হতে পারার আকুতি, নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খার গল্প, বর্তমান সমাজের অসহায়তা আর পাপবোধের কথা।
জয়মোহন নয় ,শিবসুন্দরের মৃত্যুটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল প্রথম। আদিত্য রায়, যে একজন আদ্যপ্রান্ত অপদার্থ বলেই মনে হচ্ছিল ,শেষবেলায় তাকে বড় অসহায় মনে হল। এমন একজন পুরুষ যে সুসন্তান হতে পারেনি, স্বামী হিসেবে কর্তব্য করতে পারেনি,পিতা হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেনি বাপ্পা-তিতিরের। কিন্তু যে মানুষ গুলো, সকল জাগতিক কর্মে অক্ষম হয় তারাই হয়তো ক্ষমার মহীরুহ হয়। হতে পারে সেটা তার অসহায়ত্বের দরুন, অথবা সেটাই ঈশ্বরের তাকে দেওয়া আশীর্বাদ।
বড় উপন্যাসগুলোতে সাধারণত অনেক চরিত্ররা থাকে, এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এরা সবাই একে অপরের খুব কাছের মানুষ। কিন্তু এই চেনাজানা মানুষের ভীড়ে অনেকেই আবার খুব একলা, খুব নিঃসঙ্গ। উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় পাতায় যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তার বেশিরভাগই খুব সাধারণ। একটি যৌথ পরিবারে যা যা ঘটে থাকে। সেই চিরন্তন ভাঙ্গাগড়ার খেলা। আমাদের চারপাশে যেমনটি হচ্ছে। বড় পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ার গল্প। বড় বাড়ি ভেঙ্গে অ্যাপার্টমেন্ট উঠে যাচ্ছে তার গল্প। চির পরিচিত মানুষের মৃত্যুর পর বদলে যাওয়া বাড়ির পরিবেশের গল্প। এই সবকিছু তো আমাদের জীবন থেকে নেওয়া। আর এই সব ঘটনা উপন্যাসে আবর্তিত হয়েছে ইন্দ্রানী আর তিতিরকে কেন্দ্র করে, উপযোগী সঙ্গত করেছে অন্যান্য চরিত্ররা তা বলাই বাহুল্য।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য বরাবরই আমার অন্যতম প্রিয় লেখিকদের মধ্যে একজন, তার গল্পের বাঁধুনি, এত চরিত্রের মধ্যে এসেও কখনও দুর্বল মনে হয়না।কিছু বই হয় সমুদ্রের মত। সেই সমুদ্রের ঘটনা গুলোর সাথে, চরিত্র গুলোর সাথে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হয়, ভাসতে ভাসতে কখন যে পাড়ে আছড়ে পড়ে তা যেন টের পাওয়া যায় না। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কাছের মানুষ ঠিক যেন তেমন এক সমুদ্র, ঘটনা, চরিত্র, জীবন, বাস্তব, জয় - পরাজয়, প্রতিকূলতায় ভরা এক অকূল পাথার।
উপন্যাসের নামটি ভারী ব্যঞ্জনাময়। গল্পের পাত্রপাত্রী সবই যেন আমাদের অতি পরিচিত, নিকটজন। অর্থাৎ কাছের মানুষ। আবার এই নিকটজনরা পরস্পরের খুব আপন হওয়া সত্ত্বেও সত্যিই আদেও কি কেউ কারও প্রকৃত কাছের মানুষ? নাকি সবটাই নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার সুকৌশল? একজন মানুষ কি সম্পূর্ণ ভুল বা সম্পূর্ণ ঠিক হতে পারে? দোষে - গুণেই তো একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে...
নিজেদের জীবনে, উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের মাঝে কে কার কাছের মানুষ আপনিও পড়তে পড়তে খুঁজে নিন না হয়...
রিভিউটি লিখেছেনঃ Aishee
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।