বাল্মীকির রামায়ণে নেই
রাজা ভট্টাচার্য
এই মুহূর্তে ভারতের রাজনীতিতে রাম ও রামায়ণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। একদল রামের নামে পারলে মানুষ কেটে ফেলেন। অন্যদল আবার পারলে তার গুষ্টি উদ্ধার করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। রাম ও রামায়ণ এখন চরিত্র আর মহাকাব্যের গন্ডী ছাড়িয়ে গেছেন। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই বইটি অনেক প্রচলিত ধোঁয়াশা কাটাতে সাহায্য করবে।
ইদানীং বেশ কিছু গ্রুপে যেমন রাবণকে নিয়ে বেশ ধনাত্মক সব প্রবন্ধ (চলতি ভাষায় হ্যাজ বলাই ভাল) তেমনই শুনতে হয় লক্ষ্মণ তো অন্যায় যুদ্ধে মেরেছে ইন্দ্রজিৎকে। প্রতিবাদ করতে গেলে শুনতে হয় 'রামায়ণের অনেক ভার্সন, মধুসূদন কি না পড়ে লিখেছেন?' এখন মধুকবি যে ফ্যানফিকশনই লিখেছেন মেঘনাদবধ কাব্যে, তা বললেই কিছু লোকের চূড়ান্ত রাগ হয় তখন আবার বিশেষ রাজনৈতিক দলের পোষ্য হবার খেতাব জুটে যায়। এমনকি এও শুনতে হয় শূর্পণখা ধর্ষিতা হয়েছিলেন। যদিও শূর্পণখা উবাচ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়লে তাকেই অন্য কারোর ধর্ষণের কারণ বলে মনে হয়; যেভাবে বর্ণনা দিয়ে রাবণকে বারবার উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছেন তা সুবিবৃত। মহাকাব্যটি নিয়ে আলোচনা বা প্রবন্ধের আড়ালে লেখক, বাল্মীকির রত্নাকরত্ব ঘুচিয়েছেন যেমন সুন্দর যুক্তিতে, তেমনই সাবলীল ভঙ্গিতে মধুকবির চাপিয়ে দেওয়া কলঙ্কের দায়ভার থেকে মুক্ত করেছেন রামানুজকে।
এরপরে আসি অগ্নিপরীক্ষা। উফ, সে আরেক 'হট টপিক'; শুধু তাই নয়, রামকে গালাগাল দেবার আর সেই সঙ্গে 'আমার রাম তোমার রাম' করে নিজেকে বিজ্ঞ প্রমাণ করার এক সুবর্ণ সুযোগও। একদম নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে অগ্নিপরীক্ষা প্রসঙ্গে রামের কলঙ্কমোচনের দায় নিয়েছেন লেখক এবং তাতে তিনি সম্পূর্ণ সফল।
সীতা, অহল্যা প্রসঙ্গে সমাজ কীভাবে নারীকে পিছিয়ে দিয়েছে সে বর্ণনা ও যুক্তিজাল আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রতিটি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করলাম না। অদ্ভুত আবেশ ঘিরে রেখেছে আমাকে। তবে কী কী প্রবন্ধ আছে তার একটি তালিকা দিলাম, উৎসাহীরা দেখে নিন।
১) বাল্মীকির উৎস সন্ধানে
২) রাম না জন্মাতেই রামায়ণ
৩) ইন্দ্রজিতের মৃত্যুরহস্য
৪) মারীচের প্রকৃত সংবাদ
৫) ঠুমক চলত রামচন্দ্র
৬) আগুন দেখেছি আমি
৭) সীতাহরণ পালাঃ লক্ষ্মণের গন্ডি
৮) সীতাহরণ পালাঃ শূর্পণখা উবাচ
৯) সীতাহরণ পালাঃ সীতা উবাচ
১০) তরণীসেন বধ
১১) ঘরশত্রু বিভীষণ
১২) শবরীর প্রতীক্ষা
১৩) ভরদ্বাজের আমন্ত্রণে...
১৪) ছায়াসীতা
১৫) অহল্যা-উদ্ধার
১৬) অকাল-বোধনে আমি তোমাকে চাই...
১৭) সেতুবন্ধনম্
১৮) হনুমানের সমুদ্রলঙ্ঘন
১৯) রাবণের হরধনু-ভঙ্গ
২০) রাবণ-বধ
২১) নায়ক থেকে পরমপুরুষ
বইটির সবথেকে বড় গুণ এটি রামায়ণ সংক্রান্ত আলোচনার বই, সেই অর্থে প্রবন্ধের বই অথচ ভাষাটি পড়লে মনে হবে পাশের বাড়ির জেঠু অফিস সেরে এক কাপ চা হাতে নিয়ে ছোটছোট ভাইপো ভাইঝিদের রামায়ণের সারসত্য শেখাতে বসেছেন। সেখানেই জিতে গেছে লেখনী।
তবে কয়েকটি মুদ্রণপ্রমাদ কষ্ট দিল।
প্রচ্ছদ এবং অলঙ্করণ এই বইয়ের উপযুক্ত বলে মনে হয়নি। দুঃখিত।
লেখক পরিচিতিতে দেখলাম রামায়ণের মহাসমুদ্র থেকে তুলে আনা এটিই প্রথম ঝিনুক। তাই আশা রাখি এমন আরও অনেক ঝিনুক আমাদের করায়ত্ত হবে ভবিষ্যতে।
এই অবশ্যপাঠ্য বইটি মহাকাব্যপ্রেমীরা যদি এখনও সংগ্রহ না করে থাকেন তবে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন।
পাঠ শুভ হোক।
বইয়ের নাম : বাল্মীকির রামায়ণে নেই
লেখক: রাজা ভট্টাচার্য।
রামায়ণ কে সাহিত্য না সত্য কাহিনী এগুলোর মধ্যে না ফেলে যদি সাহিত্য বলে বিচার করা যায় তবে এই বইটি আপনার জন্য। রামায়ণ লেখার আগে এটি সঙ্গীত হিসাবে লোকের মুখে মুখে ফিরত। ফলে যখন এটি লিপিবদ্ধ হয় তখন লেখ্য রূপ ভাবানুবাদ ও বিভিন্ন ঘটনা সমষ্টি হয়ে দাঁড়ায় যা বাল্মিকী রামায়ণ ছিলনা। কৃত্তিবাস ওঝা ও তুলসীদাস রামায়ণ রচনার ক্ষেত্রে নিজেকে সাহিত্যিক হিসেবে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করলেও অনেক ঘটনা বিকৃত করে দিয়েছেন। অনেক কিছু নিজের মত করে রামায়ণে স্থান দিয়েছেন। তাই এই বইটি মূল রামায়ণের সাথে অনুদিত রামায়ণের ঘটনা তারতম্য দেখিয়েছেন। উদাহরন হিসাবে আমরা ধরে নিতে পারি লক্ষণের টানা গণ্ডি। যা স্বয়ং রবি ঠাকুরের ছেলেবেলায় উনাকে বেঁধে রাখতো। বা অপর একটি উদাহরণ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে মেঘনাথ বধ। যা নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন নিজের অমর কাব্য মেঘনাদ বধ কাব্য। তিনি এই কাব্যেও লিখেন অস্ত্রহীন মেঘনাদ কে লক্ষণ কিভাবে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু সেটি যে পুরোপুরি মিথ্যা এবং একটি fare match হয়েছিল তা বাল্মিকী রামায়ণ থেকে লেখক দেখিয়েছেন। এছাড়াও এমন এমন সুক্ষ বিষয়ের ওপর তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছন।
রামায়ণ ও মহাভারত নিয়ে যাদের কৌতুহল তারা এই বইটি পড়ে দেখতে পারেন। কিন্তু সর্বোপরি দেবদত্ত পট্টনায়ক এনার সীতা বইটি যতগুলো retelling কভার করেছিলেন এখানে লেখক শুধুমাত্র কৃত্তিবাস ওঝা তুলসীদাস জির লেখায ই তুলে এনেছেন।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Abhishek
বই - বাল্মিকীর রামায়ণে নেই
লেখক - রাজা ভট্টাচার্য
প্রকাশক - পত্রভারতী
মুদ্রিত মূল্য - ২৭৫ টাকা (অমূল্য)
মহাভারতের দিকে বেশী ঝোঁক থাকায় সেদিকে সময়টা বেশী দেওয়া হয়। নিজের অলসতার কারণেই রামায়ণ খানিক ব্রাত্য হয়েই থেকে গেছে। যদিও ছোটোবেলায় ঠাকুরদার মুখে রামায়ণ শুনে Outline সম্পর্কে ধারণা রয়েছে৷ এরপরে ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে রামায়ণ সংক্রান্ত নানা আলোচনা পড়ে এবং রামকে মর্যাদা পুরুষোত্তম বলা চলে কিনা এ নিয়ে নানা বিতর্কে রামায়ণ নিয়ে বেশ সম্যক ধারণা অবশ্য হয়েছে। একদিন এরকমই এক আলোচনা থেকে জানতে পারি যে এই যে অগ্নিপরীক্ষার কথা সেটা বাল্মিকী রামায়ণে নেই। নেই অকাল বোধন এর কথাও। যদি আপনাকে বলা হয় যে “সমগ্র ভারত জুড়ে বহু শতাব্দী ধরে যে লক্ষণরেখা অমোঘ নিষেধাজ্ঞার প্রতীক হয়ে উঠেছে বাল্মীকিরচিত রামায়ণে এই গণ্ডিটিই নেই। " আপনি ভাববেন যে নেশা করে কথা বলছে। আজ্ঞে না মশাই রাজা বাবু সত্যি কথাই বলেছেন।
তারপর থেকেই মনে প্রশ্ন আসে যে আর কী কী নেই বাল্মিকী রামায়ণে। সেই সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন রাজা ভট্টাচার্য নামের সেই স্কুল মাস্টার।
কেন পড়বেন এই বই?
তার কারণ লেখকের ভাষাতেই বলছি। “রাম ইদানীং সর্বাধিক চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু সেই চর্চার পিছনে যতখানি আবেগ আছে ততখানি জিজ্ঞাসা নেই।জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র নয়, বিশুদ্ধ ভক্তির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবেই তিনি পরিগণিত হচ্ছেন। মহাকাব্যের দুরন্ত গতি ও রাজকীয় আড়ম্বরের দ্যুতিতে আমরা যে সকল ঘটনাকে সেভাবে খেয়াল করিনি, সত্যি বলেই মেনে নিয়েছি সে সমস্ত ঘটনায় আলো ফেলেছে এই গ্রন্থ।” লেখক তুলনা করেছেন মূলত ৩ জন লেখক এর মধ্যে। বাল্মীকি, কৃত্তিবাস আর তুলসীদাস। প্রমাণ করেছেন যে বাল্মীকির রামায়ণ এর চেয়ে এরা কোন কোন জায়গায় ভিন্ন। চিনিয়েছেন সেই মানুষ রামকে, যেখানে রাম একজন বীর। যিনি রাবণকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারেন তেমন বীর। “রাম শুধু দৈবী ক্ষমতা সম্পন্ন একজন অবতার নন, তাঁর কাহিনী নীরবে আমাদের অনন্ত অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার।” দেখিয়েছেন সেই সীতাকে যে কৃত্তিবাস এর সীতার চাইতে আরো স্বাধীন, আরো ব্যক্তিত্বপরায়ণ। বুঝতে শিখিয়েছেন যে “ভক্তি রসের আধিক্য ঠিক এমনই করে নিজেরই অজান্তে মানুষকে অবতার, বীরকে ভগবান হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে তার যা প্রধান গুণ তাতেই আঁচর কেটে বসে ভুল করে। রামায়ণের গল্প টা আসলে একজন অসামান্য মানুষের নিজেকে ছাপিয়ে গিয়ে অসাধ্য সাধন করার গল্প বলে।”
এই বই চিনতে শিখিয়েছে সেই অন্তরতম সত্তাকে। যেখানে প্রতিদিন যুদ্ধ চলে রাম রাবণ এর। যেখানে রাম ঈশ্বরও নয়, ব্রহ্মও নয়, সে মানবব্রহ্ম।
শেষে লেখকের কথা দিয়েই বলি - “অবতার রামচন্দ্রকে পুজো করে, ভক্তি পুষ্পে আচ্ছন্ন করে ঠাকুর ঘরে বন্দী করে দিলে তাই সেই অনন্য সাধারন মানুষটির প্রতি অন্যায় করা হবে। তার চেয়ে ঢের ভাল হবে একবার বাল্মিকী বিরচিত রামের জীবন কথাটা ভালো করে পড়ে দেখলে।
কারণ তা একটা অভিযাত্রাকে দেখায়। মানুষ থেকে পরমপুরুষ হয়ে ওঠার যাত্রাপথের গল্প বলে। তা বলে চেষ্টা করে যাও, অন্যকে দোষ দিয়ে অজুহাত তৈরি করে লাভ নেই! তোমার সবটুকু দিয়ে লড়ে যাও! তোমার নিজস্ব যুদ্ধক্ষেত্রে। রাবণের সাধ্য কি তোমাকে হারায়! সর্বস্ব পণ করে যে যুদ্ধ করে, জয় তারই করায়ত্ব হয়। রামের যুগেও হত আজও হয়।
রাম আমাদের পথ দেখাচ্ছেন যে! আজও!!"
প্রতিটা উপহার হোক বই
রিভিউটি লিখেছেনঃ Yudhistir
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।