আমার সন্ন্যাস জীবন ও বেলুড়মঠ - স্বামী সোমেশ্বরানন্দ Amar Sannyas Jibon O Belurhmoth by Swami Someswaranudhyan

আমার সন্ন্যাস জীবন ও বেলুড়মঠ - স্বামী সোমেশ্বরানন্দ Amar Sannyas Jibon O Belurhmoth by Swami Someswaranudhyan

আমার সন্ন্যাস জীবন ও বেলুড়মঠ 
স্বামী সোমেশ্বরানন্দ 
গিরিজা লাইব্রেরি 


সন্ন্যাস নেবার পর তিনদিন বাইরে ভিক্ষা করে খেতে হয়। সকাল নটায় বেড়িয়ে পড়তাম ভিক্ষায়। দুজনের গ্রুপ। একেক গ্রুপ একেক দিকে যাবে। একই বাড়িতে একাধিক সন্ন্যাসী ভিক্ষা করবেনা। তিন থেকে পাঁচ বাড়ির বেশী ভিক্ষা নেওয়া যাবেনা। শুধু রান্না করা খাবার নেওয়া যাবে, টাকা পয়সা নয়।

মঠের মেন গেটের কাছে অনেক মহিলা পুরুষ দাড়িয়ে রয়েছেন নবীন সন্ন্যাসীদের ভিক্ষা দেবেন বলে। আমরা কয়েকজন তাই লুকিয়ে পিছনের গেট দিয়ে বেড়িয়ে গেলাম, ইচ্ছে ছিল সেই পাড়ায় যাব যেখানে আমাদের কেউ চেনেনা। প্রায় মাইল খানেক হেটে একটা পাড়ায় ঢুকলাম। এক বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়াতেই উপরের বারান্দা থেকে এক বৃদ্ধা বললেন : এসেছো বাবা, একটু দাড়াও, আমি আসছি। তিনি নীচে নেমে ঝুলির মধ্যে ঢেলে দিলেন ভাত, ডাল, আলু, পটল ভাজা, ফুলকপির তরকারি

ওখান থেকে অন্য পাড়ায় গেলে জবরদস্ত অভিজ্ঞতা হল। দরজা খুলে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন: আপনি কোন আশ্রমের? বললাম বেলুড়মঠের। শুনেই তিনি চোখ গোল গোল করে বিস্ময় প্রকাশ করলেন: সে কি? মঠের সাধু হয়ে ভিক্ষা করছেন? বেলুড়মঠের আর্থিক অবস্থা এত খারাপ যে সাধুরা রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করছে? তার স্ত্রী ভুরু কুচকে আমার দিকে তাকালেন। পরে স্বামীকে বললেন আমার সন্দেহ হচ্ছে। কালই তো বেলুড়মঠে খিচুড়ি প্রসাদ খেয়েছি, আজকেই অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেল? এই সাধু নিশ্চই ঠগ। বেলুড়মঠের নাম করে ভিক্ষা চাইছে।

পাড়ার লোক ঘিরে ফেলেছে। সবাই চেচাচ্ছে – এ চোর নয়তো? আমি তো নার্ভাস। তাদের বুঝিয়ে বললাম বেলুড়মঠের নম্বর দিচ্ছি আপনারা ফোন করে জেনে নিন আমার সম্পর্কে। ভিক্ষা তো দিলই না, উল্টে পুলিশের ধমকি।

পরের দিন এক মুসলমান বস্তিতে গেলাম। এক বাড়ির বারান্দায় দুজন মহিলা গল্প করছিলেন। ভিক্ষা চাইতে এক মহিলা আসছি বাবা বলে ভিতরে ঢুকে খালি হাতে বেড়িয়ে এলেন। এসেই আমার সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। কোথায় থাকি, বাড়ি কোথায় ছিল, কতদুর পড়াশুনা ইত্যাদি। এমন সময়ে একটি বাচ্চা ছেলে বাইরে থেকে এল। হাতে ঠোঙা। পরে এক বাটিতে মুড়ি এনে আমায় ভিক্ষে দিলেন। জানলাম যে বাড়িতে খাবার নেই। স্বামী রিকশা চালান। ১২ টার সময় চাল ডাল নিয়ে আসবেন, তখন রান্না হবে। সন্ন্যাসী এসেছেন ভিক্ষা চাইতে। তাকে খালি হাতে পাঠাতে নেই। তাই ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন বাজার থেকে মুড়ি আনতে।

এক বাড়িতে ভিক্ষা নিচ্ছি। ভদ্রমহিলা রুটি আলুর তরকারি দিচ্ছেন। তার ছেলে চকোলেট খাচ্ছিল, মাকে দেখল কিছুক্ষন। ছুটে এসে পকেট থেকে একটা চকোলেট বার করে ঝোলায় দিয়ে দিল। ভদ্রমহিলা কি করছ বলে চেচিয়ে উঠতেই বাচ্চাটি অম্লানবদনে বললো – ভিক্ষা দিচ্ছি। তার দিকে তাকিয়ে আমি হাসিমুখে “থ্যাংকিউ” বলতে বাচ্চাটি হতভম্ব হয়ে আমার দিকে দেখল কয়েক সেকেন্ড। তারপর মার উদ্দেশ্যে বললো মামমি ভিখারি ইংরেজি বলছে। মা লজ্জিত।

একদিন ভিক্ষার শেষে বেলুড়মঠে ফিরে আসছি। একটা গলিতে ঢুকতেই এক ভদ্রমহিলা থামালেন আমাকে। বললেন – একটু দাড়ান, ভিক্ষা দেব। তাকে বললাম আর ভিক্ষা নিতে পারব না, পাঁচ বাড়ি হয়ে গেছে। তিনি করুণ মুখে বললেন দু ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে আছি, আপনারা কেউ এলে ভিক্ষা দেব। আপনি এলেন, আর আমার ভিক্ষা নেবেন না? তিনি প্রায় কেঁদে ফেললেন। আমি অপ্রস্তুত। বললাম: ভিক্ষা নেব, নিয়ে আসুন। মঠে যখন ফিরলাম তখন ঝোলার অবস্থা খারাপ। ঝোলে ঝালে মিশে একাকার। সবার ঝুলি থেকে ভিক্ষান্ন বার করে রাখা হল একটা গামলায়। সব মিলে মিশে মহাপ্রসাদ। গাছের নীচে লাইন করে বসে গেলাম আমরা, শালপাতায় পরিবেশন করা হল মহাপ্রসাদ। খাওয়া শুরু করলাম। কি খাচ্ছি, কেমন স্বাদ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। খিদে লাগলে সবই অমৃত।

বেলুড়মঠের কর্মকান্ড, সন্ন্যাস জীবন সম্প্কে অনেক বিস্ময়কর, অজানা ঘটনা সংকলিত করা হয়েছে এই বইতে। তার একটা ছোট অংশ উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

রিভিউটি লিখেছেনঃ 

Post a Comment

0 Comments