বই : আমার জীবন
লেখক: রাসসুন্দরী দাসী
প্রকাশনী: দে বুক স্টোর
রেটিং : ৮.৫/১০
বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মচরিত এই বই, তাও আবার একজন নারীর লেখা। দীনেশচন্দ্র সেন এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বইয়ের ভূমিকায় বইটি সম্পর্কে খুব সুন্দর মূল্যায়ন করেছেন। লেখিকার জন্ম ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের অন্তঃপুরবাসিনী এই মহিয়সী নারী সেদিন নিঃশব্দে সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বলা চলে। সেসময়ের আর পাঁচজন মেয়ের মতোই ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবন― স্বামী, সন্তান, পরিজন নিয়ে ভরপুর সংসার। জীবন সীমান্তে এসে তিনি যখন ফিরে তাকান সে দিকে তাঁর উপলব্ধি হয়, তিনি ছিলেন মোটের উপর সকলেরই ভালোবাসার পাত্রী। তাঁর বর্ণনায় সেযুগের একটি স্বচ্ছল পরিবারের গৃহবধূর এবং অন্তঃপুরের সুন্দর একটি নিটোল ছবি ধরা পড়েছে। নিজের সম্পর্কে বলতে তিনি খুবই কুন্ঠিত, তবু তিনি সারা জীবনে যা দেখেছেন তারই ধারাবিবরণী লিখে রেখেছেন ― একটি সহজ, সরল বালিকার ধাপে ধাপে সংসারের প্রাজ্ঞ গৃহিণী হয়ে ওঠার ছবি ধরা আছে তাতে। তবে সে লেখার প্রকাশ, বা নিজের প্রচার কোনোটাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি তাঁর পড়তে-লিখতে শেখার ধারাবাহিক পরিক্রমাটিই মূলত স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন এই আত্মজীবনীতে। সেই যুগে গৃহজীবনের গন্ডিতে থেকেই তিনি শিক্ষার, বিশেষত নারীশিক্ষার প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর অক্ষর পরিচয়, পড়তে শেখা এবং ধীরে ধীরে লিখতে শেখার পুরো যাত্রাপথটি তিনি খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন। নিজের সবথেকে বড় যে দুর্বলতার কথা তিনি বলেছেন, তা হলো ভয়। কিন্তু নিজের দুর্বলতা তিনি নিজেই কাটিয়েছেন। তাঁর শক্তি ছিল তাঁর ঈশ্বর ― তাঁর দয়ামাধব। ভগবানের উদ্দেশ্যে তাঁর স্বরচিত কয়েকটি গানও গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে। দীর্ঘজীবনে যেমন আনন্দের মুহূর্ত এসেছে, তেমনি শোকও পেয়েছেন তিনি, জীবনে এসেছে জটিল সমস্যা ― তবে সে সবই তিনি সঁপে দিয়েছেন দয়ামাধবের কাছে। জীবনের মূলমন্ত্রগুলি বড় সহজে তিনি শিখিয়ে দেন। প্রায় ২০০ বছর আগের এক অন্তরালবর্তিনী তাঁর অতি সাধারণ স্মৃতিচারণে যে আধুনিকতা, যে পরিণত মনন এবং রুচির ছাপ রেখে গেছেন, তার তুলনায় আমরা আজকের দিনেও আদৌ কতটা আধুনিক হতে পেরেছি, তা নিয়ে সত্যিই নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে। সবশেষে বলি, যুগের এত তফাৎ সত্ত্বেও, এ লেখার সুখপাঠ্য ভাষা ও প্রাঞ্জল বর্ণনাভঙ্গি গল্প শোনার পথে একবারও অন্তরায় হয়না।
রিভিউটি লিখেছেনঃ সুদেষ্ণা ব্যানার্জী
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।