স্বস্ত্যয়ন - শুচিস্মিতা ধর Swostyoyan by Suchismita Dhar

স্বস্ত্যয়ন - শুচিস্মিতা ধর Swostyoyan by Suchismita Dhar

বই -  স্বস্ত্যয়ন
লেখিকা - শুচিস্মিতা ধর
প্রকাশনা - বিভা পাবলিকেশন
মূল্য - ১২৩ টাকা
রেটিং - ৮.৫/১০


ভূত ভুতুমের পেজে অনেকদিন ধরেই দেখছিলাম সবাই লেখিকা শুচিস্মিতা ধরের লেখা গল্প এবং বইয়ের খুব ভালো ভালো রিভিউ দিচ্ছিলেন, কিন্ত আমি এর আগে অর্থাৎ স্বস্ত্যয়ন বইটি পড়ার আগে পর্যন্ত তার লেখা কোন গল্প পড়িনি। তাই কালীগুনীন বইটির সাথে যখন স্বস্ত্যয়ন বইটির যখন কম্বো অফার ছিল তখনই বইটি অর্ডার দিয়ে ফেলি। বইটি হাতে পেয়েছিলাম অনেকদিন, কিন্ত এর আগে আরো কয়েকটি বই পড়া বাকি ছিল তাই এই বইটি পড়া হচ্ছিল না। এরপর জমে থাকা বইগুলো তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে, গত রবিবার বইটি নিয়ে পড়তে বসি সকাল সকাল। 

বইটি একটি গল্প সংকলন, তিনটি গল্প আছে এই বইতে। 
১. স্বস্ত্যয়ন
২. পূর্ণাৎ
৩. সেই নারকেল গাছটা

"স্বস্ত্যয়ন" এবং "পূর্ণাৎ" আলাদা আলাদা গল্প হলেও একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আপনি বলতেই পারেন "স্বস্ত্যয়ন" এর পরের পর্ব হচ্ছে "পূর্ণাৎ"। "স্বস্ত্যয়ন" পড়তে পড়তে যে যে প্রশ্ন আপনার মাথায় আসবে, "পূর্ণাৎ" পড়লে তার উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন। (যদিও কয়েকটি বিষয় আমার এখনো বোধগম্য হয়নি)

১. স্বস্ত্যয়ন - কলকাতার ভিআইপি বাজারের কাছে এক বহুতল আবাসনে হঠাৎ করেই কিছু অলৌকিক ও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে থাকে, যার ফলে ঘটে যায় কয়েকটি খুন। পুলিশও দিশেহারা খুনি ধরতে। তারপরই জানা যায় এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে আছে এক তীব্র প্রতিশোধ স্পৃহা.... না আর কিছু বলে গল্পটা স্পয়লার করবো না। বাকি গল্পটা জানতে হলে পড়তে হবে এই গল্পটি।

২. পূর্ণাৎ - এক বিকৃতমনা ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট আর তার স্ত্রী কলকাতার এক প্রাইম লোকেশনে খুব কম দামে এক ফ্ল্যাট কেনে। সেই বাড়িতে ওঠার পর থেকেই সেই এজেন্টের স্ত্রী কাউকে একটা দেখতে পান। আর সেই সাথে আবারও অলৌকিক কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা ও খুন ঘটতে থাকে শহরে। কেন বার বার এই রকম অলৌকিক ঘটনা ঘটছে শহর জুড়ে? কে জড়িয়ে আছে এই সব ঘটনার সাথে? আর কেনই বা সে এই সব করছে? জানতে গেলে গল্পের বাকিটা আপনাদের পড়তে হবে।

বলতে পারেন প্রথম গল্পটা পড়ে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্ন এসেছিল, আর সেই প্রশ্নের সমাধান পেয়েছি দ্বিতীয় গল্পতে। যদিও কয়েকটি বিষয় আমার এখনো বোধগম্য হয়নি সেগুলো নীচে লিখছি,

a. প্রথম গল্পে বর্ণনা করা হয়েছিল 'মালঞ্চ' যখন তার কাকা ও কাকিমাকে হত্যা করে তখন তার চিৎকারে ফ্ল্যাটের সবাই জেগে গেছিল, এমনকি ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ডও ছুটে এসেছিল। অথচ পরের গল্পে আবার বলা হয়েছে 'মালঞ্চ' যখন তার কাকা ও কাকিমাকে হত্যা করে ও 'সম্বিত'কে আহত করে, নিজে নিজের হাত কেটে ফেলেছিল, তখন আহত 'সম্বিত' তার বোনকে কিলারদের ফোন করতে বলে 'মালঞ্চ'কে খুন করার জন্য। এখানেই আমার খটকাটা লাগছে যে সারা বাড়ির লোক যখন জেগে গেছে, সিকিউরিটি গার্ড এসে গেছে, তখন কিলার এসে 'মালঞ্চ'কে হত্যা করলো কিভাবে? 

দ্বিতীয় গল্পে লেখা 'সম্বিত'দের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর 'মালঞ্চ'কে খুন করা হয়। এবার এখানেও প্রশ্ন জাগছে, একটা ফ্ল্যাটে যখন মেডিক্যাল ইমারজেন্সি হয়েছে, সিকিউরিটি গার্ড এসে গেছে, আশপাশের ফ্ল্যাটের সবাই জেগে গেছে, সেখানে শুধু দুইজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, বাকি থাকা 'মালঞ্চ'কে কেন নিয়ে যাওয়া হল না? আচ্ছা তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম সবাই ভেবেছে 'মালঞ্চ' মারা গেছে তাই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি। কিন্ত যখন পুলিশ তদন্ত করলো, তখন পুলিশ কেন খুঁজে বার করার চেষ্টা করলো না 'মালঞ্চ'কে?

b. গল্পে প্রথমে বলা হল 'মালঞ্চ'কে খুন করে স্টোররুমে আলমারির পেছনে লুকিয়ে ফেলো হয়। আবার পরে বলা হয়েছে তাকে স্টোররুমের মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হয়। এইবার প্রশ্ন হল তিন তলার (প্রথম থেকে দুটি গল্পতে বলা হয়েছে তৃতীয় তলের কথা) মেঝেতে একটা ডেড বডি পুঁতে ফেলা হল কিভাবে? মানে বলতে চাইছি তিনতলার মেঝে মানে তো দোতলার ছাদ, তাহলে দোতলার লোক কেন কেউ টের পেল না? 

এই দুটি বিষয়কে যদি সড়িয়ে রেখে বাকি গল্পটি বিবেচনা করি তাহলে বলতেই পারি লেখিকা একটা ভালো গল্প আমাদের উপহার দিয়েছেন। তবে কোথাও যেন আমার মনে হয়েছে ঘটনা গুলোর বিবরণ সংক্ষিপ্ত রেখেই, কেমন খাপ ছাড়া ভাবে তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়া হল গল্পটাকে।

৩. সেই নারকেল গাছটা - বুঝতেই পারছেন নামের মধ্যেই গল্প লুকিয়ে আছে। কলকাতার একটা বাড়িতে থাকা নারকেল গাছে লুকিয়ে থাকে এক ভয়ঙ্কর শয়তান। যাকে কেউ নিযুক্ত করেছে সেই বাড়িতে বসবাস করা স্ত্রীদের হত্যা করার জন্য। কে সে? কে নিযুক্ত করলো তাকে? আর কেনই বা নিযুক্ত করলো? জানতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে এই গল্পটা। 

গল্পটা জাস্ট অসাধারণ লেগেছে আমার। গল্পটা পড়ার আগে ভাবছিলাম গল্পটা পড়বো কিনা, কারণ বইয়ের পেছনে গল্পটার যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া আছে, তাতে "অনাত্মীয়া" গল্পের বইয়ের সাথে এই গল্পটির যে সম্পর্ক আছে, তা বোঝা যাচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম নিশ্চই এই গল্পটা "অনাত্মীয়া" বইটির গল্পগুলোর পরের অংশ হবে, কাজেই "অনাত্মীয়া" বইটি না পড়লে এই গল্পটি নিশ্চই বোঝা

যাবে না। তাও ভাবলাম নিশ্চই নতুন গল্প হিসাবে গল্পটি পড়া যেতে পারে, তাই গল্পটি পড়া শুরু করেছিলাম। 

আর তারপর রিভিউ দিতে গিয়ে আমার মুখ দিয়ে বা হাত দিয়ে "জাস্ট ওয়াও" বা "অসাধারণ" এই সব বিশেষণই শুধু বের হচ্ছে। গল্পটাতে কোথাও খুঁত আমার নজরে আসেনি, তবে ওই শেষের দিকে সারা রাত ধরে মন্ত্র পাঠ করে যাওয়ার বদলে যদি সেই শয়তানের সাথে একটু লড়াই থাকতো তাহলে যেন আরো ভালো লাগতো। 

 বইটির প্রথম দুটি গল্প পড়ে মনে হয়েছে সমাজে নারীদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় অবিচারের গল্পগুলি লেখিকা তার লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। লেখিকা নিপুনভাবে একটি নারীর ভিতরকার যন্ত্রনা ও তার থেকে সৃষ্ট জিঘাংসাকে তুলে ধরতে পেরেছেন পাঠকদের সামনে। তাই পাঠকদের মনেও সেই চরিত্রের প্রতি দুর্বলতা বা সহানুভূতি জাগতে বাধ্য। আর সেই জন্য প্রথম দুটি গল্পতে ভয় ব্যাপারটা মিসিং। কিন্ত শেষ গল্পটাতে লেখিকা এত সুন্দর ভাবে ভয়ের পরিবেশ তৈরী করেছেন যে, গল্পটি পড়তে পড়তে আমার নজরও বাড়ির পাশে থাকা নারকেল গাছটার দিকে মাঝেমাঝে চলে যাচ্ছিল। এই গল্পটা আমার এতটাই ভালো লেগেছে যে, আমি ঠিক করেছি "অনাত্মীয়া" গল্পের বইটিও নিজের সংগ্রহে রেখে দেব।

বইটিতে এক জায়গাতেই সামান্য প্রিন্টিং মিসটেক চোখে পড়েছে। এছাড়া বইয়ের প্রিন্টিং কোয়ালিটি, বাইন্ডিং কোয়ালিটি ও পৃষ্ঠার কোয়ালিটির জন্য বিভা পাবলিকেশনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। এই সব কিছু মাথায় রেখে যদি বইটিকে নম্বর দিতে হয়, তাহলে আমি ১০ এর মধ্যে ৮.৫ নম্বর দেব। 
আর যদি শুধু "সেই নারকেল গাছটা" গল্পটিকে নম্বর দিতে হয়, তাহলে সেটাকে আমি ৫ এর মধ্যে ৫ দেব।

আরো একবার ধন্যবাদ জানাই লেখিকাকে এত সুন্দর একটি বই আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। আর অপেক্ষায় থাকবো "সেই নারকেল গাছটা" গল্পের মত আরো ভয়ের গল্পের।

লিখেছেনঃ Adhiraj Biswas:l

Post a Comment

0 Comments