পটমঞ্জরী - অভীক সরকার Pata Monjury by Avik Sarker

পটমঞ্জরী - অভীক সরকার Pata Monjury by Avik Sarker

উপন্যাস পটমঞ্জরী 
লেখক অভীক সরকার


পটমঞ্জরী একটি ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস। মূলত পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল এর সিংহাসন আরোহনের পূর্বে, গোটা বাংলা জুড়ে যে মৎস্যানায় ও ধর্মীয় রীতি পালনের নামে অন্তহীন অজাচার, সামাজিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল লেখক এখানে কেবল সেই প্রেক্ষাপট টিকে গ্রহণ করেছেন আর তার সূত্রেই এসেছে তৎকালীন কিছু পরিচিত চরিত্র এবং কিছু কাল্পনিক চরিত্র। 
তৎকালীন সময়ের ও তার ও পূর্বের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক উত্থান পতন, রাজপরিবার বা রাজানুগত অমাত্য কর্মচারীদের ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদির বিবরণে এটি একটি রোমাঞ্চকর থ্রিলার বললেও অত্যুক্তি হয়না। আর বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় এর ব্যাপ্তি, চিনদেশ থেকে তিব্বত গান্ধার ও শেষে ভারত এর বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল এর কথা ঘটনপরম্পরায় এসেছে, এসেছে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের বর্ণনা সবটা মিলে এক বিশাল ব্যাপ্তি আছে এই উপন্যাসের। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এক সুবিশাল পরিসরে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানুষ নিজ স্বদেশকে গ্লানিমুক্ত করতে কতদূর ত্যাগস্বীকার করতে পারে, কতখানি মরিয়া হয়ে উঠতে পারে তার মনোগ্রাহী দলিল এই উপন্যাস। তবে এই উপন্যাস এর সার্বিক রসাস্বাদনের জন্য অবশ্যই পাঠক এর অতিলৌকিক-অধিভৌতিক জ‍‌ঁর প্রিয় হতে হবে এবং উপন্যাস হিসাবেই গ্রহণ করতে হবে, ইতিহাস এর প্রামাণ্যগ্রন্থ পড়ার আশা করলে আশাহত হতে হবে।
উপন্যাসের মধ্যে মধ্যে চর্যাপদের কিছু পদ এর ব্যবহার, পদকর্তাদের কিছু নাম এর ব্যবহার উপন্যাসটিতে সেযুগের আবহ যোগ করেছে, বাংলাভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শনের রচনার প্রেক্ষাপট এর আভাস ও কিছু অংশে পাওয়া যায় এখানে,কেমন পরিস্থিতিতে পদকর্তারা সন্ধ্যাভাষার আড়াল নিতে বাধ্য হতেন। 'পটমঞ্জরী' নামটিই চর্যাপদের প্রথম রাগ এর নামকরণে দেওয়া,চর্যাপদের প্রথম পদ 'মায়া তরুবর পঞ্চ বি ডাল', কাহ্নপা'র লেখা। রাগ পটমঞ্জরী,বস্তুত উপন্যাসটি বাংলাসাহিত্যের প্রথম নিদর্শনের প্রসঙ্গ টেনে সম্পূর্ণ কাল্পনিক আশ্রয়ে বর্ণনা করেছে সেযুগের বাংলার আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় অবস্থা ও তার ক্রমন্নতির সম্ভবনায় ঘটেচলা কাল্পনিক ঘটনাপ্রবাহ এর মূল উপজীব্য।  আজই হাতে পেয়েছি এই সুখপাঠ্য উপন্যাসটি আজকেই শেষ করে ফেললাম। সঙ্গে পাঠানো বুকমার্কটিও বেশ সুন্দর।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Palashpriya

পুস্তক পর্যালোচনা 
বই:  পটমঞ্জরী 
লেখক:  অভীক সরকার 
প্রকাশক ও মূদ্রক:  পত্র ভারতী 
মূল্য:  ৩৯৯ টাকা।  
নভেম্বরের মাঝামাঝি কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে নতুন বইয়ের সন্ধান করতে করতে হঠাৎই চোখ পড়লো এই উপরোক্ত বইটির দিকে। কৌতূহলী হয়ে হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতেই যে শব্দগুলো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, সেগুলি হলো, “বৌদ্ধধর্ম”, “বজ্রযান”, “তিব্বত”। ইদানীংকালে উক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কিত বেশ কিছু কাহিনী রীতিমতো উপভোগ করেছি আর এই বইটি কলেবরেও যথেষ্ট সন্তোষজনক (আমার আবার স্থূলকায় বইয়ের প্রতি দুর্বলতা আছে); তাই আরোও দুটি বইয়ের সঙ্গে এটিকেও কপাল ঠুকে কিনেই ফেললাম আমি। এই প্রসঙ্গে আমার একটা বিশ্রী বদভ্যাসের কথা সকলকে জানিয়ে রাখি, বই কেনবার সময়ে প্রায়শই আমি লেখকের নামের দিকে দৃষ্টি দিই না। ফলতঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বই পড়ে শেষ করে ফেলবার পরেও লেখকের নাম আমার অজানাই থেকে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। 
ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে বইটি পড়া শুরু করতেই লেখকের নাম আমার গোচরে এলো। অভীক সরকার – যাঁর লেখার সঙ্গে আমি সুপরিচিত – আমার অন্যতম প্রিয় লেখক। “এবং ইনকুইজিশন”, “প্রেতবত্থু” প্রমুখ অসাধারণ উপন্যাসগুলি পড়ে তাঁর সুলেখনীর ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এই বইটিরও দু’চার পাতা পড়েই চমৎকৃত হলাম। কারণ, দেখলাম সপ্তম-অষ্টম শতকে বঙ্গদেশের মাৎস্যন্যায় এই গল্পের মূল পটভূমি। 
যতোই পড়ি, শিহরিত হই। বঙ্গদেশে মাৎস্যন্যায়কালীন অরাজকতা, রাজপুরুষগণের নিজস্বার্থ চরিতার্থ করিবার্থে কুটিল চক্রান্ত, রক্তলোলুপ শাসকগণের অকথ্য নিষ্ঠুর অত্যাচারে জর্জরিত, নিপীড়িত ক্ষুধার্ত বঙ্গবাসীর অসহায় হাহাকার, অবহেলিত বনবাসী অন্ত্যজ শ্রেনীভুক্ত বীর যোদ্ধাদের সহায়তায় একদল দুঃসাহসী প্রতিবাদী সহজিয়া ও শৈব সাধকগণের নেতৃত্বে এক মহাবিদ্রোহ এবং পরিশেষে জননির্বাচিত হয়ে গোপালদেবের সিংহাসনাসীন হয়ে পালবংশের সূচনা তথা মাৎস্যন্যায়ের অবসানের বিবরণই কাহিনীর মূল বিষয়। সুবিশাল এই উপন্যাসের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করেছে মহাচীনের তাং রাজবংশের মদতপুষ্ট, বঙ্গভূমির চরম সর্বনাশেচ্ছু ক্রুরবুদ্ধি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন চিরযুবক সাধক প্রকাশচন্দ্র ও তাঁর সাধনসঙ্গিনী এক মনুষ্যরূপী উগ্র হলাহল উদ্গীরণকারী কালনাগিনী, যে প্রকাশচন্দ্রের হীন চক্রান্তবলে বঙ্গদেশের মহারানীরূপে সিংহাসনারূঢ়া সুজলা সুফলা বঙ্গভূমিকে এককথায় শ্মশাণে পরিণত করে ফেলেছে। এই দুই অপশক্তির পরাজয় ঘটে দুঃসাহসী সাধক লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ, অভিজ্ঞ প্রৌঢ় যুদ্ধ ব্যবসায়ী বপ্যট, কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াপীড়, বৌদ্ধাচার্য শান্তরক্ষিত ও তাঁর সুন্দরী ভগিনী ভিক্ষুণী মন্দর্ভা, কামরূপ রাজপুত্র পদ্মসম্ভব, অত্যাচারিতা প্রতিশোধাগ্নিতে জ্বলতে থাকা তরুণী দেদ্দাদেবী ও অতি অবশ্যই বপ্যটপুত্র স্থিতধী বীর গোপালদেবের রুদ্ধশ্বাস সংগ্রামে। দুঃসাহসী তরুণী, পরবর্তীকালে পালবংশের প্রথমরাজমহিষী দেদ্দাদেবী ও গোপালদেবের স্নিগ্ধ প্রেম এ কাহিনীর অন্যতম আকর্ষণ। 
এছাড়াও কাহিনীতে আছে তৎকালীন সহজিয়া চর্যাগান সমন্বিত বুদ্ধনাটিকার প্রসঙ্গ – মহাবিদ্রোহের অচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে প্রখ্যাত দুই চর্যাকার কাহ্নপাদ ও শবরপাদ নিজেরাও সশরীরে বর্তমান।  
কল্পনা ও বাস্তবের মেলবন্ধনে নিঃসন্দেহে এক রোমহর্ষক কাহিনী। কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমি বারে বারে হেসে আকুল হয়েছি। না। এই রোমহর্ষক সুবিশাল কাহিনীর ঘটনা পারম্পর্য বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখক কোথাও এতোটুকু বালখিল্যতার পরিচয় দেননি। প্রতি ছত্রে অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সঙ্গে ঘটনা পরম্পরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু তা’ও আমি প্রাণ খুলে হেসেছি। 
তার কারণ, কাহিনীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র – পদ্মসম্ভব। মহাবিদ্রোহে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী এই কামরূপ রাজকুমার অতিশয় দয়ালু, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান, অত্যন্ত বিচক্ষণ, দুঃসাহসী মহাবীর, সব্যসাচীরূপে অব্যর্থলক্ষ্যে অস্ত্রচালনায় তাঁর সুনিপুণ দক্ষতা থাকলেও; স্বভাবতঃ তিনি মাত্রাছাড়া পরিহাসপ্রিয়। বিশেষ করে মহিলাদের প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শণ করেও শানিত বাক্যবাণে উত্যক্ত করে তাঁদের ধৈর্যের শেষসীমায় পৌঁছে দিতে তাঁর কোনোও বিকল্প নেই। তাঁকে স্বয়ং বিষ্ণুর অবতাররূপে অভিহিত করলে তিনি নির্বিকারচিত্তে বক্তার কাছে ষোলো হাজার গোপিনী প্রার্থণা করেন। বিদ্রোহের পরিকল্পনা ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ তথা গুরুগম্ভীর আলোচনার মধ্যেও তাঁর চঞ্চল অক্ষিদ্বয় সদানিবদ্ধ থাকে সুন্দরী রমণীর প্রতি এবং সুযোগমতো সকৌতুক মন্তব্যের দ্বারা সর্বসমক্ষে তাঁদের বিড়ম্বনায় ফেলতেও এতোটুকু দ্বিধাবোধ করেন না। তাঁর উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে সর্বত্যাগী ভিক্ষুণী মন্দর্ভা সর্বদাই রোষানলে লোহিততপ্ত – প্রতি পদে অগ্নিদৃষ্টি হেনে পারলে যেন ভস্ম করে দেন, এই অর্বাচীনটিকে। এমন কি পদ্মসম্ভব নামধারী এই “কলির কেষ্ট”-টিকে যথাসম্ভব উত্তমমধ্যম প্রদান করবার যথেষ্ট আগ্রহও সুন্দরী ভিক্ষুনীটির মধ্যে বারে বারেই জাগ্রত হয়েছে। শেষপর্যন্ত অবশ্য রীতিমতো হলিউডি প্রথা মেনে মধুরেণ সমাপয়েৎ, ভিক্ষুণীর গৃহীতে প্রত্যাবর্তণ – খুব সম্ভবতঃ প্রেমিকপ্রবরকে আমৃত্যু সমুচিত শিক্ষাদানের মহৎ উদ্দেশ্যেই। 
পরিশেষে বলি, উপন্যাসের অন্তিমে নাগিনী ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও লেখক কিন্তু প্রকাশচন্দ্রের অন্তিম পরিণতি উহ্যই রেখেছেন এবং তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করবার সুযোগ দান করেছেন। সুতরাং এই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বের সম্ভাবনা থেকেই যায়। 
পর্যালোচকের রেটিং: ৯/১০

রিভিউটি লিখেছেনঃ শ্রীজিত মিত্র

Post a Comment

0 Comments