নি:সঙ্গ সম্রাট by সুনীল গঙ্গপাধ্যায়

নি:সঙ্গ সম্রাট by সুনীল গঙ্গপাধ্যায়

নি: সঙ্গ সম্রাট
সুনীল গঙ্গপাধ্যায়।

প্রকাশ্য কলকাতার রাজপথে এক সন্নিহিত গলি পথ।পাওনা অনাদায়ে শ্রী রঙ্গম থিয়েটারের ঘর থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে মালপত্র। পাশে দাঁড়িয়ে এক আনত মস্তিস্ক মানুষ। তার দিকে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে কলকাতা। বেদনায় হতাশায় তারা দেখছেন এক মুকুটহীন সম্রাট কে। যার হাত ধরে বাংলার থিয়েটার প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েছে, পেয়েছে বিশ্ব পরিচয়। সাধারন মানুষের কাছে তখনও তিনি সম্রাট আলমগীর বা নাদির শাহ - তিনি শিশির কুমার ভাদুড়ী। অলোক উজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চ যার অভিনয়ে রিদ্ধ হয়েছে, ভেসেছে হেসেছে কেঁদেছে,ভালো ভেসেছে, প্রেমে পড়েছে বারবার,যার একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য প্রখ্যাত মানুষ গুলোও কাঙাল হয়েছে, প্রাজ্ঞা পেয়েছে।যিনি শুধু থিয়েটারে যাপন করেছেন, তার হাত ধরে সারা পৃথ্বীর মানুষের কাছে আসতে চেয়েছেন।তার ভাবনার উদ্দাম স্রোতে কাল অগ্রগামী  সময় থমকেছে। তাই তিনি নিঃসঙ্গ।শুধু এক সমান্তরাল নাগরিক জীবন তার অনুগামী হতে চেয়ে বিপরা হয়েছে তাকে দলিত মথিত করে তার স্পর্ধিত অহংকারের জবাব দিতে গিয়ে তাকে বার বার ঠেলে দিয়েছে বঞ্চনার ইতিহাসের গর্ভে।
শুধু একটাই স্বপ্ন ছিল তার, বিদেশী শৃঙ্খলা মুক্ত এক আপাদমস্তক বাংলা নাট্যমঞ্চ গড়ার।যখন থেটার মানে কিছু সস্তা বিনোদন, ভাড়ামি, চটুল সংলাপের বাতাবরণ,সেখানে রবীন্দ্র ঘনিষ্ঠ শিশির বাবু বার বার থিয়েটারে নাট্য রূপ দিতে চেয়েছে ন  বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য মানিমুক্ত গুলি।যার মধ্যে যোগাযোগ, গোরা,বিরাজ বউ, দত্তার মতো অনন্য বাংলা সাহিত্যের কাল জয়ী উপন্যাস সমূহ।সময়ের অগ্রবর্তী ধ্যান ধারণা তাকে বারবার সময়ের বিসর্পিল চাবুকে করেছে ক্ষত বিক্ষত। কিন্তু যে মানুষ শুধু থিয়েটারে জীবন প্রদত্ত, যে শুধু চরিত্র কে সত্য নিষ্ঠ করে গড়ে তোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘন্টা, লাইব্রেরী তে সময় কাটান, এক পর্তুগীজ সারা জীবন জলে থাকে তাই ডাঙায় থাকলেও সে দুলুনির মধ্যে থাকবে সেই সত্য প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি মঞ্চে দর্শকের কটূক্তির শিকার হলে বই ও মানচিত্র খুলে দর্শকের ক্লাস নেন মঞ্চেই, নাটক চলাকালীন সময়েই।জীবনে সঙ্গিনী হিসাবে পেয়েছিলেন কঙ্কাবতী কে।তখন সেই সময়ে এত শিক্ষিত, নাট্য প্রাণ ও সর্বোপরি শিশির কুমারের সমো মনষ্ক নারী অতি দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথ, শেকসপিয়র, Byron  তার আত্মগত।স্টার থেকে পালিয়ে এসে নাট্য মন্দিরে যোগ দিয়ে শত বাধা পায়ে ঠেলে তিনি শিশির বাবুর সঙ্গে আমৃত্যু সংযুক্ত থেকেছেন। আমেরিকা Biltmore Broadway r flop show অনাহার,থেকে শিশির বাবুর জীবনের ওঠাপরা তিনি গায়ে মেখেছেন অনায়াসে। তার, সন্তান গর্ভে ধরেছেন,অভিনয়ে সমান দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন শুধু এই দুঃখ নিয়ে গেছেন শিশির বাবু তাকে স্ত্রী র মর্যাদা দেননি। তার পরিচয় ও মানুষ ভুলেছে।তার পরিচয় এখন তিনি অভিনেত্রী চন্দ্রা বতি দেবীর বোন।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু শিশির বাবু কে আর সংসার জীবনের মঞ্চে এন্ট্রি দেইনি ঠিক। আসলে অন্য মঞ্চ তাকে এত টাই প্রভাবিত করেছিল  যে, তার জীবন, আদর্শ, ভাবনা, অন্য তাদের যারা উত্তর ও সমসাময়িক  কাল এর স্ব মহিমায় আছেন তারাও তাতে অনুসৃত। কিছু নাম বলাই যায়,সুনীতি কুমার, মানিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, রাখলদাস বন্দোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, ভারতী দলের প্রত্যেকে,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, শম্ভু মিত্র,নবকুমার,বসু, আর কত নাম বলা যায়। কারণ তিনি শিশির ভাদুড়ী। যিনি অভাবের দীঘি তে গলা অবধি নিমজ্জিত হয়েও শুধু থিয়েটার কে ভালো বেসে ফিরিয়েছেন সত্যজিত রায় এর জলসাঘর ছবির নামভূমিখার প্রস্তাব। সারাজীবনের স্বপ্ন শুধু সযত্নে লালন করতে গিয়ে বার বার প্রশ্ন করেছেন, its the cause, but what is the cause, তাইত তার প্রশ্ন bt রোডের ধারের লাল বাড়িতে ভেসে বেড়ায় কল্পিত মঞ্চের অলোক অন্ধকারে।

Only themselves understands themselves
And the like of themselves
As souls understands souls
সুনীল গাঙ্গুলী র এই জীবনধর্মী উপন্যাস তাই বাস্তব কল্পনা পেরিয়ে যায় সীমারেখা।

Post a Comment

0 Comments