📕নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি
✍কল্লোল লাহিড়ী
সম্প্রতি শেষ করলাম সদ্য প্রকাশিত হওয়া সুপ্রকাশ প্রকাশনার আমার অন্যতম প্রিয় লেখক কল্লোল লাহিড়ী বাবুর উপন্যাস নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি।সীমাহীন মুগ্ধ হয়েছি আলোচ্য উপন্যাসটি পড়ে।লেখককে কুর্নিশ জানাই এরকম একটি মনোগ্রাহী লেখা পাঠকদের উপহার দেবার জন্য ।কল্লোল লাহিড়ী মানেই একটু ব্যতিক্রমী লেখা ।চেনা ছন্দের বাইরে গিয়ে একটু অন্যরকম প্রেক্ষাপট, একটু অন্য রকম বিষয়, চরিত্রায়ন সবকিছুতেই চেনা ছকের বাইরে থাকে এক অভিনবত্ব এবং নতুনত্বের ছোঁয়া। আলোচ্য উপন্যাসটিও লেখক তুলে ধরেছেন এক নিত্যনবরূপ মাধুরী দিয়ে ।যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
নব্বই দশকের প্রজন্ম নিয়ে অনেক কথা অনেক গল্প আজও চায়ের আড্ডায় প্রজন্ম প্রতিনিধিদের নস্টালজিক করে তোলে। তবে নব্বই দশকের প্রজন্মকে সংজ্ঞায়িত করার সুনির্দিষ্ট কোন রেখা মনে হয় কোনও আলোচনাতে নেই ।নব্বই দশকের প্রজন্ম বলতে আমরা কাদের বুঝি? নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়া না আশির দশকে জন্ম? নাকি নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে? তবে মোটামুটিভাবে বলা যায় বর্তমান সময়ে যাদের বয়স তিরিশের কোটায় তারাই মূলত নব্বই এর দশকের ।নব্বই দশকের প্রজন্মই সম্ভবত প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা সর্বশেষ প্রজন্ম। জীবনের সর্বস্তরে প্রযুক্তির প্রসারের সবচেয়ে বড় সাক্ষী এই প্রজন্ম ।মাটির কাছাকাছি এবং মাঠ মাটি আর জলের স্পর্শে কাটানো দুরন্ত সেই সময়গুলো কোনও ফ্রেমে আবদ্ধ করা হয়নি ঠিকই কিন্তু মনের ফ্রেমে সেই সময়গুলো আজও এখনো অম্লান। তখন গুঁটি কয়েক বাড়িতে টেলিভিশন কিন্তু পাড়ার সমবয়সী অসমবয়সীদের মধ্যে যে আবেগ এবং গভীরতা এবং একাত্মভাব দেখা যেত তা আজ আর হাজার চেষ্টা করেও পুনরায় পাওয়া সম্ভব না ।সেই সময়েই তৈরী হওয়া একেক মনের একেক টানাপোড়েন, একেক জটিলতা, প্রেম অপ্রেম, বন্ধুত্ব কিংবা বন্ধুত্বের মধ্যেও পেতে চাওয়া এক নিষিদ্ধ ভালোলাগা এবং ভালোবাসার অবয়ব, ব্রণ মুখে জর্জরিত হলেও আয়নায় নিজেকে শাহরুখ খান ভাবা, মহালয়ার ভোরে সকলে মিলে দূরদর্শনে সংযুক্তা ব্যানার্জিকে দুর্গা রূপে দেখে তাঁকেই প্রণাম করা, ইংরেজি নতুন বর্ষে গ্রিটিংস কার্ড দেবার মধ্যে দিয়েই চলে যেত দিন গুলো।
কিন্তু দুটো ছেলের মধ্যে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্বের আরও এক ধাপ এগিয়ে দুটো ঠোঁটে নিষিদ্ধ ভালোবাসার এক পূর্ণ আশ্রয় খোঁজা, একটি পুরুষও আকৃষ্ট হয়ে ওঠে তাঁরই এক সহপাঠী পুরুষ বন্ধুটির প্রতি, তবুও মাঝে মাঝে পড়ার ব্যাচে অন্য কোনও মেয়ের প্রতিও সমান ভালোলাগা, সবই দেখেছে নব্বইয়ের দশক। আর এইসব আখ্যান দিয়েই সাজানো কল্লোল বাবুর আলোচ্য উপন্যাসটি।
এই উপন্যাসের মূল চরিত্র ফেলে আসা নব্বই দশকের এক টুকরো সময়। যে সময়েই স্বপ্নে আন্দোলিত হয়েছে তরুণ যুবা যুবতীরা, নিজেকে কখনো কেউ মাধুরী দীক্ষিত তো কেউ কাজল ভেবেছে। অপর দিকে কেউ ভেবেছে নিজেদের কে সলমান খান। ঘটনার ঘনঘটায় আলোচ্য উপন্যাসের প্রকৃত একটি চরিত্রই হয়ে উঠেছে সেই সময় ।যেখানে কিংশুক, দিপালী, পচা, বিশু, হুলো আর মন্টু এবং আরও অন্য অনেকে মিলে একটা পাড়া, একটা স্কুল, একটা ভাঙা নদীর ঘাট, একটা ধুঁকতে থাকা সিনেমা হল, একটা লাস্ট বেঞ্চ। তার সাথে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের ভাবভালোবাসা, প্রেম, বন্ধুত্ব, নিষিদ্ধ প্রেম, গোপন ভালোলাগা, আর একটা সময়, দুই শালিখ, নিঃসঙ্গ লেনিন, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা, চোখের জল,আর একটাই কালপুরুষ এই নিয়েই সাজানো 'নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি' উপন্যাসটি।
ব্যাকরণের লিঙ্গ অনুযায়ী কার শরীর মন্টুকে বেশি প্রলুব্ধ করতো তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা ছিল তার সেই বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই। স্ত্রী লিঙ্গ তাকে টানতো না ।সে কি তবে সমকামী হয়ে উঠেছিল?
কেনই বা তাকে জীবনের একটা সময়ে এসে খুন হতে হলো?
সুইমিং পুলে রক্তে ভেসে যাওয়া শরীরেও তার চোখ দুটি আকাশের দিকে ছিল। তবে কি সে তখনও কালপুরুষটিকে খুঁজে ছিল।
অপরদিকে কিংশুক যার উত্তম পুরুষের বক্তব্যেই এই উপন্যাসটি শুরু এবং শেষ তাকে যেভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কলমের মুন্সিয়ানায় তা সত্যিই স্বার্থক হয়ে উঠেছে ।আসলে সময় এবং অপরিণত বয়স এই দুটি দিকই উপন্যাসটির দুটি স্তম্ভ। প্রতিনিয়ত মনের মধ্যেকার ওঠাপড়া, নানান উত্তেজনা, শরীরে মননে মস্তিষ্কে নানান রকম দোলাচলে এগিয়ে যাওয়া তো কখনো পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে তৈরী হওয়া নানান উচাটন নানান দ্বিধা নিয়েই এই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়ে চলে আপন ধারায়। সেই সাথে তৎকালীন রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা, রাষ্ট্র তথা আন্তর্জাতিক স্তরে নানান রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ কিভাবে এখানকার মানুষকেও প্রভাবিত করেছিল সেই কাহিনীই ব্যক্ত করে জীবনের আলোছায়া মেশানো এই উপন্যাসটি পরিশেষে সকল বইপ্রেমী মানুষদের আলোচ্য উপন্যাসটি পড়ার অনুরোধ জানিয়ে এবং লেখককে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া এখানেই শেষ করছি।
প্রেম শব্দটি গভীর এক গভীর থেকে গভীরতর এক পরশ নারী পুরুষে, নারীতে নারীতে পুরুষে পুরুষে যুগে যুগে সেই ভালোবাসা আশ্রয় খোঁজে। পরিধি বিস্তার করে।
বলতে চায় ভালোবাসাটাই আসল। প্রেম সমপ্রেম বিষমপ্রেম যাই আসুক আশ্রয় পাওয়াটাই বড় কথা।
লিঙ্গ তো বিধিনিষেধের কেবল মন তো তা নয়। সেখানে শরীর, লিঙ্গ তুচ্ছ হয়ে ফুটে ওঠে কেবল দুটি মনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা......
চুম্বন সেখানে প্রথম আলোক সম্পাত...
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।