মরুতীর্থ হিংলাজ by কালিকানন্দ অবধূত

মরুতীর্থ হিংলাজ by কালিকানন্দ অবধূত

বই : মরুতীর্থ হিংলাজ 
লেখক: কালিকানন্দ অবধূত 
প্রকাশনী: মিত্র ও ঘোষ 
রেটিং : ৮.৫/১০ 
 
বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের ধারার একটি বিখ্যাত গ্রন্থ এটি। সমনামের সিনেমার দৌলতে কম বেশি সবাই মূল কাহিনির সঙ্গে পরিচিত। তবু সিনেমা ও বইয়ের তফাত তো আছেই। লেখক চলেছেন হিংলাজ দর্শনে। রুক্ষ মরুপথে গোটা যাত্রা ― প্রভূত শারীরিক কষ্ট, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে পথে। লেখক নিরাসক্ত সন্নাসী হলেও নানা ঘটনায় ঘরের প্রতি তাঁর টান, পারিবারিক জীবনের ছোটো ছোটো সুখ-দুঃখের মধুর স্মৃতিচারণ, গৃহজীবনে ফিরে যেতে না পারার আক্ষেপ তিনি প্রকাশ করে ফেলেছেন। এ শুধু খেয়ালের ভ্রমণ নয়, এ হলো তীর্থ, সফল হলে অশেষ পুণ্য অর্জন। কিন্তু তীর্থপথে চলতে চলতে শেষে আর থাকে না সেই পুণ্যেরও মোহ, তখন যেন শুধু অভ্যাসে এগিয়ে যাওয়া। কঠিন শারীরিক শ্রম, ক্লান্তি, তারই ফাঁকে শুষ্ক মরুর মধ্যে জীবনের ফল্গুধারার সন্ধান; স্নেহ, প্রেম, বন্ধুত্ব, প্রকৃতির অপরূপ, অভাবনীয় জাদুর সন্ধান যেমন লেখক পেয়েছেন, তেমনি আবার মানুষের অন্ধকার দিকের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে তাঁর। হটকারিতায় করে ফেলা পাপের জন্য দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে দেখেছেন মানুষকে, দেখেছেন বীভৎস মৃত্যু, বিশ্বাসঘাতকতা। আবার সেই মানুষেরাই বিপদের দিনে অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, শূন্য মরুর বুকে দুহাতে সাজিয়ে দিয়েছে তৃপ্তির উপাদান। মরুপথের একঘেয়েমি দূর করেছে বিচিত্র মানুষ, আর তাদের নানান অদ্ভুত কাজকারবার। একই সঙ্গে প্রকৃতি আর মানুষের রুক্ষ ও কোমল দুই দিক মিলিয়েই সম্পূর্ণতার ছবি এঁকেছেন তিনি। সহজ আর সরস ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির জন্য পাঠকও যেন যাত্রীদলেরই অংশ হয়ে পড়ে। যুগের বাধা, ভূগোলের সীমা পেরিয়ে পাঠকমন সাক্ষী হয় চিরকালের, চিরজীবনের পথ পরিক্রমার।

পাঠ প্রতিক্রিয়া
অবধুত এর লেখা "মরু তীর্থ হিংলাজ"

অবধুত এর লেখা এই প্রখ্যাত উপন্যাস টি নিয়ে বিকাশ রায় পরিচালিত, বিকাশ রায়, উত্তম, সাবিত্রী অভিনীত বিখ্যাত সিনেমা টা বেশ কয়েকবার দেখা। বই টা সংগ্রহে থাকলেও আগে পড়া ছিল না। থ্রিলার ও তন্ত্র সম্পর্কিত আধুনিক লেখা গুলোর থেকে মুখ পাল্টাতে হটাৎ ই এই বই টা শুরু করলাম।
অধুনা পাকিস্তান এর মরু প্রান্তরে হিন্দুদের অন্যতম শক্তিপীঠ হিংলাজ। কথিত আছে দক্ষ যজ্ঞে পতির অপমান সহ্য করতে না পেরে সতীর দেহত্যাগের পর, দেবাদিদেবের তাণ্ডব নৃত্যে ধ্বংসপ্রায় জগৎসংসার রক্ষা করতে নারায়ণ সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ খন্ড খন্ড করে দেন। হিংলাজ শক্তিপীঠ গড়ে উঠেছে সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র এর ওপর ভিত্তি করে।  হিংলাজ মাতার মন্দির স্থানীয় মুসলিম দের কাছেও 'নানী কি হজ' হিসেবে পবিত্র স্থান। 
জনা ত্রিশ সহযাত্রীর সাথে অবধুত আর ভৈরবীর হিংলাজ যাত্রা শুরু করাচী শহর সন্নিহিত হাব নদীর ধার থেকে। মাল পত্র, খাবার বহন আর দলের একমাত্র মহিলা সদস্য ভৈরবী মাতার জন্য দুটি উট এর ব্যবস্থা হয়।সাথে থাকে দুজন ছড়িদার ও পান্ডা। ধূ ধূ মরু প্রান্তরে পথ চেনার একমাত্র ভরসা উট এর মর্জি। ১৪ দিনের কঠিন মরু পথ পেরিয়ে পৌঁছতে হয় মাতা হিংলাজ এর কাছে। সেই নির্দেশহীন জনমানবহীন পথে জল ও বিশ্রাম এর জন্য ভরসা বহু দূরে দূরে অবস্থিত কিছু কুয়ো কখনোবা তৎসংলগ্ন পাথুরে দালান। কিন্তু সেই সামান্য আশ্রয় টুকুই অনেক খানি প্রার্থনীয় ওই নিদারুণ নির্দয় পথের তীর্থ যাত্রী দের কাছে। পথে জলের অভাবে বা শরীর অসুস্থ হয়ে পথেই যাত্রা শেষ হয় কিছু তীর্থ যাত্রীর। এমনই এক কুয়োর পাশে তীর্থ যাত্রী রা খুঁজে পায় অচেতন দুটি মানুষ কুন্তী ও থিরুমল কে। সুস্থ হয়ে তারাও সঙ্গী হয় তীর্থ যাত্রী দের। পথ চলতে চলতে অবধুতের সাথে পাঠকের জানা হয়ে যায় কুন্তী ও থিরুমল এর জীবন কাহিনী ও আরো কিছু সহযাত্রীর গভীর গোপন মর্ম ব্যথা। সেই সুকঠিন মরু পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত কোন কোন সৌভাগ্যবান তীর্থ যাত্রী দর্শন পেলো মা হিংলাজ এর, সেই কাহিনীর থেকেও, কঠিন তীর্থ পথের বিবরণ ও সহযাত্রীদের জীবনকথা, নির্দয় পথের সহযাত্রীর প্রতি কখনো নিষ্ঠুর কখনো সহৃদয় অভিব্যক্তি, এটাই এই কাহিনীর উপভোগ্য প্রাপ্তি। লেখক অবধুত এর ব্যক্তিগত উপলব্ধি অনুভূতি ও জীবন দর্শন পাঠকের অতিরিক্ত প্রাপ্তি।

রিভিউটি লিখেছেনঃ Saswata

Post a Comment

0 Comments