ক্ষপা - পরিক্ষিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় Khapa by Parikshit Bandopadhyay

ক্ষপা - পরিক্ষিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় Khapa by Parikshit Bandopadhyay

বইয়ের নাম- ক্ষপা
লেখক- পরিক্ষিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় 

বইটিকে ক্রাইম থ্রিলার বলা যায় নাকি কনফেশনাল থ্রিলার বলা যায় আমি জানি না। মাত্র ষাট পাতার একটি বই। প্রচ্ছদ দেখে আন্দাজ করেছিলাম তন্ত্র মন্ত্র বা স্যাটানিক কাল্টের ওপর কোনো বই হবে। বইয়ের শুরুতেই আবার লেখক সতর্ক করে দিয়েছেন বীভৎস রস ও শ্রুতি কটু ভাষার প্রয়োগ থাকবে গল্পে। এই রকম গল্প আমার সাধারণত ভাল লাগে না। তাই সব মিলিয়ে বইটি ভাল লাগবে প্রত্যাশা করিনি। তবুও হাতের সামনে যাই পাই তাই পড়ে ফেলার অভ্যেস বশত পড়তে শুরু করি। বলতে দ্বিধা নেই যে গল্পটি পড়ার ওই মিনিট কুড়ি সময় আমি অন্য কোনদিকে মন দিতে পারিনি, একটানায় বইটি পড়ে গিয়েছি।

      বইয়ের সারসংক্ষেপ বলব না, বললে হয়ত পুরো গল্পটিই বলে দিতে হয়। তাই শুধু এটুকুই বলব যে গল্পটি আসলে একজন সাইকোপ্যাথ কিলারের জবানবন্দি। গল্পে তন্ত্র মন্ত্র নেই, স্যাটানিক কাল্টও নেই। তবে শয়তান অবশ্যই উপস্থিত রয়েছেন, মানুষের মনের অন্ধকারের রূপ নিয়ে।

       লেখকের উপস্থাপন কৌশল অসাধারণ। যেভাবে গল্পটিকে সাজিয়েছেন, ধাপে ধাপে গল্পের মুখ্য চরিত্রের মনের অন্ধকারের মধ্যে পাঠকদের নিয়ে গিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বীভৎস রস, গা ঘিনঘিনে বর্ণনা, অশ্রাব্য ভাষা- সবই রয়েছে, কিন্তু লেখকের উপস্থাপনের মুন্সিয়ানায় তা বিবমিষার উদ্রেক করে না কারণ পাঠক গল্পের মধ্যে মশগুল হয়ে থাকেন এবং অনুভব করতে পারেন এই সমস্ত বর্ণনা ভীষণ রকমের সত্যি। এই গল্প শুধু এক সাইকোপ্যাথকে নিয়ে নয়, এ গল্প আমাদের সমাজকে নিয়েও। সাইকোপ্যাথের সাইকোপ্যাথ হয়ে ওঠার পেছনে আমাদের সমাজের যে অন্ধকার মনস্তত্ব কাজ করে লেখক গল্পের শেষভাগে গিয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে সেই চিত্র এঁকেছেন। শেষের টুইস্টখানিও ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। খারাপ লাগার জায়গা বিশেষ নেই। একটা জায়গা শুধু খটমট লেগেছে একটি। 'ছিদাম' আসলে কারুর নাম হয় না, 'শ্রীদাম' নামটির বিকৃত রূপ হচ্ছে 'ছিদাম'। সেখানে একজনের ভাল নাম রাখা হচ্ছে 'ছিদাম'-  ব্যাপারটা কেমন একটু লাগল। জানি না এর মাধ্যমে অন্যকিছু ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন কিনা, হয়ত আমিই বুঝতে পারিনি।

    যাইহোক, সব মিলিয়ে আমি গল্পটি নিঃসন্দেহে উপভোগ করেছি এবং যারা এই ধরণের গল্প ভালোবাসেন, তাদের পড়ে দেখতে বলব।
রেটিং: ৭/১০

এই বইটা এক্ষুনি হয়তো পড়তাম না। তবে কয়েকদিন আগেই অনেকে আলোচনা করছিলেন দেখে কৌতূহল হল বেশ। পড়েই ফেললাম শেষমেষ গতকাল।

সাহিত্য গুন ইত্যাদি পর্যালোচনা করার মতো জ্ঞান আমার নেই। নিজের যেটুকু মনে হয়েছে সেটাই লেখার চেষ্টা করব।

এখন যেটা প্রথমেই চোখে পড়ছে,বইটা নিশ্চয়ই খুব ক্রুড ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করে লেখা হয়েছে, সেটা দুশো পার্সেন্ট সত্যি। যে বইয়ের শুরুর আগে গ্রাফিক ভায়োলেন্স আর ন্যুডিটির ওয়ার্নিং থাকে অনেকটা যেন সিনেমার ধাঁচে, সেই বইয়ের ভিতরে সত্যিই বাড়াবাড়ি কিছু থাকবে এটা বোঝাই যাচ্ছে।

গ্রুপেও অনেকে আগে যা বলেছেন আমিও সহমত যে যৌন দৃশ্যগুলো লেখক ভীষণ ইলাবরেট করেছেন, যৌন লালসাকে বিশেষ ভাবে হাইলাইট করে গিয়েছেন বারবার একদম চাঁচাছোলা ভাষায়। সম্ভবত পাঠককে লুব্ধ করে ধরে রাখার জন্যই কি ? আমারও পুরো বইটা পড়তে পড়তে সেরকমই লাগছিল কিন্তু।

তারপর কোথায় এসে বদলে গেল জানেন? ওই যে লাস্ট চ্যাপ্টার। ষাট পাতার ছোট্ট উপন্যাসের মধ্যে অসহ্য রগরগে যৌনতা আর রেপ ফ্যান্টাসি  ছাড়া লেখক কি আর কিছুই লেখার খুঁজে পাননি এটা মনে মনে ভাবছি যখন, ঠিক সেই সময়েই ওইটা একটা সপাটে থাপ্পড়ের মতো লাগল পুরো বিশ্বাস করুন। স্রেফ এন্ডিং টুইস্ট টার জন্য আগের সবকিছু দিব্যি জস্টিফায়েড হয়ে গেল, একেবারেই যথাযথ লাগতে শুরু করল।

কেন?
কারণ বইয়ের নায়ক (অন্তত তাই আপনি ভাববেন) আপনার আমার মত প্রকৃতি কিংবা সমাজের বাঁধা নিয়মের আওতায় পড়ে না।
সোজাসুজি বলতে গেলে, গল্পটা একজন উভলিঙ্গ শ্রেণীর মানুষের, তাই তার গল্প তার চোখ দিয়েই দেখতে চেয়েছেন লেখক। খুব ভুল দেখেছেন কি? আমার মনে হয়নি।

আমাদের চেনা মাখোমাখো কাব্যিক প্রেম আর সেন্সুয়াল যৌনতার সংজ্ঞা সবসময় যে কাজে লাগে না, বিশেষ করে এমন একজন মানুষের কাছে যার জীবনে প্রেম বলে জিনিসটার অস্তিত্বই নেই। যার কাছে যৌনতা মানেই বিকৃতি, বারবার ধর্ষিত হওয়া; যার ভালোবাসার অধিকার নেই কিংবা ভালো লাগা মানেই আমার আপনার কাছে সেটা ঘৃণ্য, নোংরা অপরাধ সমান। যে মানুষগুলো রাস্তাঘাটে দেখলে অস্বস্তিতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখি আমরা, এই গল্পটা তেমনই একজনের, পড়তে হলে আপনাকেও সেই জায়গায় গিয়েই ভাবতে হবে তার পরিপ্রেক্ষিতে। সেই গল্পে কেমন করে স্মরণজিৎ চক্রবর্তী কিংবা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের নভেলের মতো সুন্দর আবেশমাখা রোমান্টিকতা আসে বলুন তো। বেঁচে থাকাটাই তো এখানে একটা অভিশাপ, একটা অনন্ত ট্রমা যেটা একজন মানুষকে পশুর ধাপে ঠেলে দিতে যথেষ্ট।

তাই সবশেষে এসে সত্যি বলতে খারাপ লাগল না। ভাষার ব্যবহার নিয়েও সেভাবে কিছু বলার জায়গা আছে বলে মনে হল না। এর চেয়ে অন্যরকম হলেই সেটা একটু মেকি লাগতো না কি?

আর তাছাড়া আরেকটা জায়গায় লেটার মার্কস পাবেন লেখক, সেটা হচ্ছে হিংস্রতা। খুনের কিংবা ভায়োলেন্সের দৃশ্যগুলোর বর্ণনা কি অনায়াস! যেন একেবারেই স্বাভাবিক, রুটিন মাফিক কোন কাজের রোজনামচা দেওয়া হচ্ছে। কোনো অতিরিক্ত উত্তেজনা বা টেনশন কোনোটাই নেই সেখান, স্রেফ নিপুণ হাতের বর্ণনা। ঠিক একজন পাকা সিরিয়াল কিলারের মতই।

আচ্ছা তাহলে বইটা কি পুরোটাই ফাটাফাটি?

অবশ্যই না। কিছু খারাপ লাগা বা খামতি আছে।

যেমন, লাস্ট চ্যাপ্টার। সেটা যেমন এই বইয়ের ইউএসপি, ঠিক তেমনই এই বইয়ের একটা অন্যতম দূর্বলতাও বটে। পাঠককে আগে থেকে কয়েক জায়গায় ভীষণ আবছা কয়েকটি আভাস দিয়ে শেষে এতবড় একটা টুইস্ট হঠাৎ তুলে ধরলে সেটা অনেকের কাছেই জোর করে মিলিয়ে দেওয়ার মত লাগবে, খুব স্বাভাবিকভাবেই। ফাইনাল রিভিল টা অন্তত একটু হলেও আস্তে আস্তে করলে আরেকটু হয়তো সহজ আর বোধগম্য হত। তাছাড়া শেষটাও একটু তাড়াহুড়ো করে, যেমন দুম করে গল্প শুরু তেমনই ফুরিয়ে গেল আর বেশি ভাবনার অবকাশ না দিয়ে।

হ্যাঁ, সবার ভালো লাগবে না। তাতে পাঠকের দোষ নেই, লেখক বইটা লিখেছেনই অল্প সংখ্যক পাঠকের জন্য যারা সাহিত্যে বিভৎসতায় অভ্যস্ত। নবরসের মধ্যে একমাত্র বিভৎস রসই এমন যেটা জোর করে ভালো লাগানো যায় না।

আমি ব্যক্তিগত রেটিং হিসেবে দেব 7/10

রিভিউটি লিখেছেনঃ Metaplastic

Post a Comment

0 Comments