ঘুর্ণি by ইন্দ্রনীল স্যান্যাল

ঘুর্ণি by ইন্দ্রনীল স্যান্যাল

উপন্যাস- ঘুর্ণি
লেখক- ইন্দ্রনীল স্যান্যাল

উপন্যাসটি পড়ার সময় পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার নূন্যতম পরিকল্পনাও মাথায় ছিল না। এমনিতেই সামাজিক উপন্যাস পড়ি না কিন্তু দিদির সাজেশন শুনে হঠাৎ করে পড়তে শুরু করি। পড়তে পড়তে রাত আড়াইটা বেজে যায়, তবুও থামতে পারি না। আমি তো সামাজিক উপন্যাস পড়ছিলাম, রহস্য রোমাঞ্চ গল্প নয়, তাহলে! ঘুর্ণি আমার মাথাটা এমন করেই ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কী বলব কী না বলব জানি না। ভীষণভাবে স্পয়লার থাকতে পারে তাই আগে থেকেই সাবধান করে দিলাম। 

      গল্প শুরু হচ্ছে জাগরী আর উজানকে নিয়ে, ওরাই গল্পের মুখ্য চরিত্র। জাগরী ৪৬ আর উজান ৪৫, মধ্যবয়স্ক এই দম্পতি স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল চিকিৎসক। 'স্ব স্ব ক্ষেত্র' বললাম কারণ কাহিনীর দ্বন্দ্ব এই জায়গাতেই। জাগরী আর উজান পরস্পরকে আর ভালোবাসে না, নিত্যদিন ঝগড়া হয়, হয় ইগোর লড়াই। সম্পর্কটা খাতায় কলমে না হলেও অন্তরের খাতায় ভেঙেই গিয়েছে আগেই। তবুও তারা একে অন্যকে ছেড়ে চলে যেতে পারছে না- কারণটা তাদের একমাত্র সন্তান, রোহন। রোহনই একমাত্র কারণ- জাগরী আর উজান অন্তঃত তাই মনে করে। জাগরী ডিভোর্সের কথা তুললে উজান চুপ করে যায়, তেড়ে গিয়ে বলতে পারে না - যা চলে যা। কারণ শুধুই রোহন! উজান আজও আদর করে জুজুবুড়ি বলে ডেকে ফেললে জাগরীর ভেতরটা নরম হয়ে যায়। কারণ তার অজানা। তারা তো পরস্পরকে আর ভালোবাসে না! বন্ধুর উপদেশ মেনে জাগরী পুরী বেড়াতে যেতে যায়, উজানকে ভালোবাসা না সত্ত্বেও সে মনেপ্রাণে চায় সম্পর্কটা ঠিক করে ফেলতে, প্রচন্ড ব্যস্ত উজানও এক কথায় রাজি হয়ে যায়। একসঙ্গে যদিও যাওয়া হয় না তাদের। জাগরী আর রোহন চলে যাওয়ার পর স্মৃতির মন্তাজে উজানের একের পর এক পর মনে পড়ে পুরোনো দিনের কথা। কলেজের প্রথম দিকে আলাপ, তারপর প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠা। বন্ধুত্ব থেকে ধীরে ধীরে মানুষটাকে অন্যরকম করে পাওয়ার অনুভব তীব্র হয়ে ওঠা। জাগরী মফঃস্বলে মানুষ, উজান মেট্রোপলিটনে। বিপরীত সংস্কৃতি। তবুও আকর্ষণ তীব্র। জাগরী অল্পেতে মাথা গরম করে ফেলে, উজান নিজের ইচ্ছেয় চলতে ভালোবাসে। দু'জনের সঙ্গে দু'জনের মত বিরোধ হয়, তবুও তারা একসঙ্গে থাকে। সম্পর্ক ভেঙে দুমদাম বেরিয়ে যায় না। এম.বি.বি.এস শেষ করে উজান বাইরে পড়তে যাওয়ার আগে দুই বাড়ির লোক বিয়ে দিতে চায়, উজান চায় পড়া শেষ করতে। জাগরী উজানের পাশে দাঁড়ায়, বিশ্বাস রাখে ভালোবাসার ওপর, বিশ্বাস রাখে ভালোবাসার মানুষটার ফেরার ওপর। উজান সত্যিই ফিরে আসে। এখন জাগরী সময় চায়, উজান সময় দেয়। বারো বছর সম্পর্কের পর বিয়ে হয় অবশেষে। বারো বছরে মাত্র একবার শারীরিক সম্পর্ক। মোবাইল ফোনের যুগ না হওয়া সত্ত্বেও ভালোবাসাটা টিকে ছিল দিব্যি। বিয়ের প্রথম দুই বছর বারে বারে সংঘাত লাগে (সরাসরি যদিও ব্যক্ত করা নেই সে কথা), তবুও বিয়ের দুই বছর পর রোহনের জন্মের সময় উজানের প্রতিক্রিয়াটা অসামান্য। উজানের মত একটা চরম কেরিয়ারিস্টিক ছেলেও নিজের সন্তানকে প্রথম দেখে কেঁপে ওঠে। অনুভব করে সে আর জাগরী আলাদা মানুষ, তাদের পছন্দ বা জীবনশৈলী আলাদা। তবুও ভালোবাসার দ্বারা তারা একটাই মানুষ, একটাই ইউনিট আর সেই ইউনিটের প্রোডাক্ট হল তাদের সন্তান।
         ফণীর ঝড়ে বিধস্ত পুরীর কথা শুনে মধ্যবয়স্ক উজান পাগলের মত পুরী পৌঁছাতে চায়, শুধু ছেলের জন্য। বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ছেলেকে রক্ষা করতে করতে মধ্যবয়স্ক জাগরী অনুভব করে সে উজানের অভাব অনুভব করছে না একটুও।ভালোবাসা মরে গেছে!
          হাসপাতালে বিধ্বস্ত উজানকে পৌঁছাতে দেখে শীতল অভ্যর্থনা জানায় জাগরী, কিন্তু মনের ভেতর বৃষ্টিতে ভেজা উজানকে দেখে জাগরী শিহরিত হয়, কেন কে জানে! উজানও ছেলের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে তবুও জাগরীর দিকে তাকায় নিস্পলক, কেন কে জানে!
          উজানকে পুলিশ ধরতে আসে। জাগরী আতঙ্কিত হয়, কান্না পায় তার। উজানের মুক্তির জন্য নাওয়া খাওয়া ভুলে বিদেশ বিভূঁতে পাগলের মত ছোটাছুটি করে সে। ভালোবাসা নেই, তবুও করে। জেল থেকে বেরিয়ে টলোমলো পায়ে উজান এসে জড়িয়ে ধরে জাগরীকে। ভালোবাসা নেই। তবুও ওই মানুষটাকেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, ভরসা করতে ইচ্ছে করে। 

           গল্পের দ্বিতীয় দম্পতি চিকিৎসক চৈতী আর আবহবিদ সঞ্জয়। মধ্যবয়স্ক এই আবহবিদের কথা সবাই জানে যে সে তার বউয়ের হাতের মুঠোয় থাকে। লোকটা কি তবে স্ত্রৈণ! শব্দটা নেতিবাচক একটা শব্দ। বুদ্ধিমান সঞ্জয় জানে তার চরম ব্যস্ততার জীবনে এক দমকা শীতল বাতাস তার স্ত্রী চৈতী। নিজের পেশা সামলে যে সমান দক্ষতায় বাড়িটাও সামলে রাখে। এমন বউয়ের কথা শোনাটা কি খুব অন্যায়? চৈতী বোঝে সঞ্জয়ের পেশায় দায়িত্ব, সে অভিযোগ করে না। সে পাশে থাকে। যেটুকু সময় সঞ্জয়কে কাছে পায়, উপভোগ করে। ভালোবাসাকে ধরে রাখে। 

          গল্প শেষ হয় গাড়িতে- বাড়ি ফেরার সময় উজান জাগরীর কাঁধে হাত রাখে, ভরসার হাত। যে হাতটা আজ থেকে বহুবছর আগে মেডিক্যাল কলেজ জীবনের গোড়ার দিকে বাড়িয়ে ধরেছিল।
        উপন্যাসে কোথাও কোনো উপদেশ দেওয়া হয়নি। তবুও গোটা উপন্যাসটাই যেন একটা শিক্ষা। আমরা যেমন ছোট থেকে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেহারার পরিবর্তন ঘটে, তেমনই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসার চেহারারও।পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তাই বলে সে ফুরিয়ে যায় না। আমাদের সেই পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে হয়। পঁচিশ বছর বয়সে এসে আঠারো বছরের উদ্দাম প্রেম যেমন চাইলে পাওয়া যায় না, তেমনই চল্লিশ বছরে এসে পঁচিশ বছরের উষ্ণতাও পাওয়া যায় না। তখন ভালোবাসা আর অভ্যাস দুটো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আজকালকার দিনে আমরা বড়ই অধৈর্য্য। ইগোর লড়াই এখন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু আমরা চাইলেই সম্পর্কটাকে ধরে রাখতে পারি। কারণ, যত যাই হয়ে যাক না কেন ওই মানুষটা যেমন করে আপনার পাশে থাকবে তেমন করে পৃথিবীর কেউ থাকবে না। কেউ যদি থাকেও তাহলে শেষমেশ দেখা যাবে তার থাকার মধ্যে আদপে কোনো স্বার্থ রয়েছে। 

        আমি উপন্যাসটা সবাইকে একবার হলেও পড়তে অনুরোধ করব। এই উপন্যাসে রেটিং আর কী দেব। আমার মুগ্ধতাই আমার রেটিং।

Post a Comment

0 Comments