ধূমাবতীর মন্দির - মনীষ মুখোপাধ্যায় Dhumavatir Mandir by Manish Mukhopadhyay

ধূমাবতীর মন্দির - মনীষ মুখোপাধ্যায় Dhumavatir Mandir by Manish Mukhopadhyay

ধূমাবতীর মন্দির 
মনীষ মুখোপাধ্যায়

এই লেখকের লেখা আগে কখনো পড়িনি, এই প্রথম পড়লাম। বর্তমান সময়ের ধারা মেনেই এটি একটি তন্ত্র আশ্রিত উপন্যাস। বেশ কিছুদিন ধরে না না জায়গায় এই বইটির নাম শুনছিলাম তাই এক বন্ধুর কাছ থেকে বইটি জোগাড় করে পড়েছিলাম।

বইটির কাহিনী আগে চট করে বলেনি তারপর নিজস্ব মতামত বলবো।
কাহিনীটা হলো: নদীয়া জেলার চাকদায় 2000 সালের এক বিকেল বেলায় এক কিশোর খেলাধূলা সেরে বাড়িতে ফেরার পথে দেখে এক আগাছার মধ্যে কাক ডাকছে। 
সেই কাকের ডাক শুনে সে সেই আগাছার মধ্যে গিয়ে এক প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসস্তুপ আবিষ্কার করে এবং চোখের সামনে অতীতের এক গর্ভবতী মহিলার নরবলি দেওয়ার ঘটনা দেখতে পায়।
তারপর স্বয়ং দেবী ধূমাবতীর আবির্ভাব ও জল্লাদের মৃত্যু ও দেখতে পায়।
এতদূর দেখে কিশোরটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং সেদিন রাতেই বাড়ি ফেরার পর তার ধূম জ্বর।
তারপর কথায় কথায় জানা যায় এক প্রাচীন অভিশাপের কথা।
যে অভিশাপ নাকি ওই চাকদার এক অন্য পরিবারের ওপরও আছে যাঁরা বর্তমানে কলকাতা নিবাসী।
তারপর কী করে অভিশাপ মুক্তি ও কিশোরটি সুস্থ হয়ে উঠলো সেটাই বাকি গল্পটা।

কাহিনীটা পড়ে আমার নিজস্ব কয়েকটা খটকা আছে সেগুলো বলছি এক এক করে (প্লিজ কেউ স্পয়লার স্পয়লার করে চেঁচামেচি করবেন না):

১. এক প্রাচীন পুঁথির বঙ্গানুবাদ দেখা যায় এই গল্পে যেটা খুব কম করেও ১০০ বছরের পুরোনো অর্থাৎ ১৯০০ সালের।
সেই বঙ্গানুবাদে লেখক বর্তমানে বাংলা একাডেমি প্রণীত "সৌন্দর্য", "কার্য" বানান লেখেন কিন্তু আমরা 1900 সালের বহু লেখায় "সৌন্দর্য্য",  "কার্য্য" এই বানান পাই।

2. এই পুঁথি থেকে জানতে পারি যে লক্ষণ সেন বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের কথা আগে থেকেই জানতে পারেন এবং সেই জন্য তিনি দুজন ব্যক্তি কে আসামে পাঠান যাতে তাঁরা তন্ত্র বিদ্যা শিখে এসে আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেন।
অর্থাৎ কোনরকম সামরিক শক্তির ওপর ভরসা না করে লক্ষণ সেন বসে রইলেন যে ওনার লোক তন্ত্র শিখে এসে উচাটন করে বখতিয়ার খিলজি কে হারাবে।

আমার ব্যক্তিগত মত, এই রকম রাজা হলে তার হারাই উচিৎ।

৩.সূর্যভট্ট ও তাঁর সঙ্গী লক্ষণ সেনের আদেশে আসাম যান তন্ত্র শিখতে এবং তাঁদের মধ্যে সূর্যভট্টকে সুর্পণখ নামে জঙ্গলে বসবাসকারী এক মহাযোগী বলেন যে তিনি শেখাবেন ঘোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে।
আরেকজন সঙ্গী সেই শেখার কদিন জঙ্গলে অন্যত্র অপেক্ষা করলো।
তারপর ১৩ দিন পর সূর্যভট্ট তন্ত্র শিখে অপেক্ষায় থাকা সঙ্গী কে এক রাত্রির মধ্যে সব শিখিয়ে দিলো।

এটা তন্ত্রের সিদ্ধি লাভ নাকি মাধ্যমিকের লাস্ট মিনিট সাজেশন ধরতে পারবেন না।

৪. এই গল্পে সেই প্রাণঘাতী অভিশাপের সূত্রপাত বলতে গিয়ে একটা গল্প বলা হয়েছে।
গল্পটায় যদিও কোনো সালের উল্লেখ নেই কিন্তু একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে।
সেই গল্পে শুরু হওয়ার প্রায় কুড়ি বছর পর সাংঘাতিক প্লেগ হয় বাংলায়।
আমরা জানি মোটামুটি ১৮৯৬-১৮৯৮ এ বাংলায় ভয়াবহ প্লেগ হয়।
অর্থাৎ গল্পের সময়কাল ১৮৭৬-১৮৭৮। লেখকের কথানুযায়ী সেই সময় "চৌরঙ্গী জঙ্গল"। ভেবে দেখুন, ১৭৮৪ তে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পার্ক স্ট্রিটে।
নতুন ফোর্ট উইলিয়াম তৈরী হচ্ছে ১৭৫৮ তে। ১৮৫৭ এর 6th জুলাই চৌরঙ্গী তে ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির দেওয়া গ্যাসের বাতি জ্বলছে কিন্তু ১৮৭৬-৭৮ এ চৌরঙ্গী জঙ্গল!!!!

এই ধরণের কালানৌচিত্য তন্ত্র লেখকদের পক্ষেই সম্ভব। আসলে পুরোনো দিনের কথা ১০০-২০০ বছরটা কোনো ব্যাপার না, এরকম তো হয়েই থাকে টাইপ।

৫. এই গল্পের নায়ক তান্ত্রিক যাঁর নাম শঙ্খশুভ্র তাঁর কাছে বিপদে  এক ভদ্রলোক এসে বলতে থাকেন "মানে আমরা থাকি হাবড়ার দিকে...."
তাঁর কয়েকটা লাইন পড়েই দেখি শঙ্খশুভ্র শিয়ালদার এক বাড়িতে ঢুকছে সেই ভদ্রলোকের ছেলে কে বাঁচাতে।
আমার ভূগোল খুব একটা জানা নেই কিন্তু শিয়ালদা কে কী বলা যায় হাবড়ার দিকে? জানা নেই।

৬. শঙ্খশুভ্র যখন ওই ভদ্রলোকের ছেলেকে বাঁচাতে যায় তখন সেই ছেলের দেহ আশ্রয়কারী প্রেতও বলে যে সে জীবদ্দশায় হাবড়ার বাসিন্দা ছিল এবং হাবড়াতেই ছেলেটি যখন কোচিং থেকে ফিরছিল তখন তার দেহ অধিকার করে কিন্তু আবার দেখা যায় শঙ্খশুভ্র সমস্যার সমাধান করে শিয়ালদা থেকে বেরিয়ে ট্রামে ওঠে।

বোধহয় গভীর তন্ত্রের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যই হল ছোটোখাটো ভৌগোলিক দূরত্ব কে পাত্তা না দেওয়া।

৭. এইখানে একটু প্রেতটার কথা বলে নি, এরকম প্রেতের বর্ণনা  আমি কখনো পড়িনি, 
প্রথমে সে শঙ্খশুভ্রকে দেখে বলে  "ওরে শালা, শুয়োরের বাচ্চা...." ইত্যাদি।
শঙ্খশুভ্র তারপর শিশিতে রাখা গঙ্গাজল ছেটায় তারপর প্রেত বলে "হ্যাঁ, চলেই যাব কিন্তু একটা কথা রাখবে বাবা? "

এই প্রথম আমি বাবা বাছা করে কথা বলা এক প্রেতের উল্লেখ পেলাম তন্ত্রের উপন্যাসের পাতা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটা যুগান্তকারী উপন্যাস।

আর গঙ্গাজল পড়া মাত্রই শুয়োরের বাচ্চা থেকে বাবা তে চলে আসা এটাও অভূতপূর্ব।


বইয়ের নাম: ধূমাবতীর মন্দির 
লেখক: মনীষ মুখোপাধ্যায়
জনরা: তন্ত্রভিত্তিক, অতিপ্রাকৃত

চাকদা অঞ্চলের গ্রামের একটি ছেলে এক বিকেলে খুজে পায় পোড়ো এক মন্দির। সেখানেই এক ভয়ংকর বৃদ্ধার মূর্তি ও বেশ কিছু ভয়াল দৃশ্য মানসচক্ষে দেখে ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ে ও ভুল বকতে থাকে। অন্যদিকে কলকাতার সাউ পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ পাচ্ছেন রজনীগন্ধার গন্ধ, যা কিনা তাঁদের পরিবারের সকল পূর্বপুরুষ পেয়ে থাকেন মৃত্যুর আগে। কীভাবে এই সব বিপদ গাঁথা আছে একই সুতোয়? এমন বিপদের সময়ে ত্রাতা হয়ে আসবে কোন মহাপুরুষ?

আগে ভালো ব্যাপারগুলো ঝটপট বলে ফেলি। গল্প বেশ জমজমাট - অসরলরৈখিক সময়কাল, পছন্দসই চরিত্র, ভয়ের আবহাওয়া, অভিশাপের ঝঞ্ঝা এবং সুন্দর সমাপ্তি। লেখক অনেক পড়াশোনা করেছেন আর সেই খাটনি পাতায় পাতায় স্পষ্ট। লেখার ভাষা ভারি সুন্দর এবং বাক্য রচনার মধ্যে বেশ সরল আসর জমানো ভাব আছে যা বেশ চটজলদি মনে ধরে যায়। পারিপার্শিক চরিত্রগুলির মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে character development প্রশংসনীয়। দু-তিনটি পরিবার ও তাদের অতীত-বর্তমান মিলিয়ে একটা টানটান অথচ ছিমছাম গল্প।

এবার আসি খারাপে। ভয়ের গল্প হিসেবে এ গল্প বড়ই সরল। শুকতারার ভূতের গল্প ও সাম্প্রতিক কালের ভয়ের গল্পের (যেমন অভীক সরকার, যাঁর সব গল্পে ভয়ের বর্ণনা একইরকম হয়; ইয়ে সেকথা এখন থাক) মধ্যে একটা ফারাক থাকে। যদি গল্পের বিষয়বস্তু হয় অনৈসর্গিক তন্ত্রসাধনা অথচ লেখনি হয় কিশোরমনস্ক তবে সে লেখা আধসেদ্ধ। বানান, ব্যাকরণগত অনেক ভুল ত্রুটি ও চারিত্রিক গড্ডালিকা প্রবাহে এ বইটি পরিপক্ক। বিদেশে পড়াশনা মানেই তন্ত্রে অবিশ্বাসী, গল্পের নায়ক মানেই সে সব জানে, সমবয়সী মেয়ে মানেই গল্পের শেষে নায়কের প্রেমে পড়তে বাধ্য – আর কত বলব? শেষের কয়েক পাতা নিতান্তই দায়সারা, তবুও সব মেনে নিতাম শুধু দুটি মারাত্মক ভুল রাগের কারণ না হয়ে দাঁড়াত। এক, গুহাবাসী অসামাজিক কোনো তান্ত্রিক কীভাবে প্রথম আলাপেই অচেনা কাউকে গুহ্যতম তন্ত্রসাধনা শেখাতে রাজি হয়ে যায়? দুই, তন্ত্রের যে সমস্ত অধ্যয়নে প্রকৃত ত্যাগির সারা জীবন কেটে যায়, গল্পের নায়ক মাত্র দুই বছরে সব শিখে ফেলে কী করে?

রেটিং: ৪/১০
লিখতে লিখতে পরিসর বাড়ে, তাই ৫-৬ দিতুম। কিন্তু কেটে নিলুম জোর করে গল্পের শেষ পাতায় দ্বিতীয় পর্ব তৈরি করার জন্য।

রিভিউটি লিখেছেনঃ তিতাস

Post a Comment

0 Comments