আনন্দবাজার পত্রিকা গল্প শতবর্ষ সংকলন - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় Anandabazar Patrika Golpa Shataborsha Sonkolon by Tarashankar Bandopadhyay

আনন্দবাজার পত্রিকা গল্প শতবর্ষ সংকলন - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় Anandabazar Patrika Golpa Shataborsha Sonkolon by Tarashankar Bandopadhyay

আনন্দবাজার পত্রিকা গল্প শতবর্ষ সংকলন 
সপ্তপদী 
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় 

      এই কৃষ্ণেন্দু  চ্যাটার্জ্জী নয় গুপ্ত এবং কৃষ্ণেন্দু নামটা তার পিতৃদত্ত নয়, বরং নিজস্ব দেওয়া।  পিতৃদত্ত নাম ছিল কালাচাঁদ যা কৃষ্ণেন্দু নামের সমান অর্থবহ। এই ছেলেটি কোনো শহুরে ছেলে নয়, নিতান্তই গ্রামের ছেলে। গুন বলতে ভালো ফুটবল খেলতো।
                      গ্রাম থেকে  শহরে পড়তে  এসে বন্ধুত্ব হয় রীনা ব্রাউন আর জন ক্লেটন এর সাথে। রীনা জনের বাগদত্তা। তিনজনের  বন্ধুত্ব দিন দিন গাঢ় হয়ে ওঠে। একদিন কালাচাঁদের বাবা শহরে এসে মুখোমুখি হয় রীনা আর কালাচাঁদের। কালাচাঁদের স্বপমাখা প্রেমিক  চোখ দেখে বাবা যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলেন এবং ছেলেকে প্রকারান্তরে নিষেধ করেছিলেন থমকে যেতে। কিন্তু নিয়তি কে খণ্ডায় কে!  কালাচাঁদের মনে প্রেমের অঙ্কুর বপন হয়ে তা থেকে চারাগাছ বেরিয়ে মাটি শক্ত করছে। রীনার বাড়ি তেও সে খুব জনপ্রিয়। রীনার  বাবা তাকে অত পাত্তা না দিলেও তার মায়ের খুব কাছাকাছি সে।  এদিকে রীনার বিয়ের সব ঠিকঠাক ইতিমধ্যে জন দেখে ফিরে গেছে এবং সেখান থেকে জানিয়েছে সে এই বিয়ে করতে পারবে না, সে অন্যত্র বিয়ে করেছে। রীনার এই ভেঙে পড়ার সময় কালাচাঁদ ছিল একমাত্র সহায়। রীনার চোখের জল মোছানোর দায়িত্ব একাই সে নিয়ে নেয়। ধর্মপ্রাণা রীনা কালাচাঁদের ওপর  নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে কালাচাঁদ রীনা কে বিয়ে করবে বলে রীনার বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যায়। রীনার বাবা তাকে ধর্মত্যাগ করে খ্রীস্টধর্ম নিতে বলে। তবেই সে রীনা কে পাবে। এতে রীনার ঘোর আপত্তি থাকলেও কালাচাঁদের কোনো আপত্তি ছিল না। 
     আজব ছেলে এই কালাচাঁদ। সে মনুষ্যত্ব ধর্মে বিশ্বাসী, কোন সাংগঠনিক ধর্ম নয় যদিও রীনা খুবই ধর্মপ্রাণা। কালাচাঁদ নিজের বাবাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে ফিরে এসে রীনা কে পায় না। এদিকে নিজের বাবাও তাকে ত্যাগ করেছে, আর ওদিকে রীনাও তাকে গ্রহণ করে না তার নিজের ধর্ম ত্যাগের জন্য। কি অদ্ভুত মনস্বত্ব দুজনের। একজন  ধর্ম বলতে বোঝে মানুষ, তাদের চাওয়া পাওয়া, ভালোবাসা আর আরেকজন যার কাছে ধর্ম হলো একটা প্রধান অবলম্বন যাকে কোনোভাবেই ছাড়া যায় না। যথারীতি ধর্মপ্রাণা রীনা ও তাকে গ্রহণ করতে পারে না এই ভেবে যে ভবিষ্যতে অন্য কোনো প্রেমের জন্য কালাচাঁদ আবার ও ধর্মত্যাগ করে ফেলবে। ভালোবাসার কি অদ্ভুত অনুভব দুজনের।
           এর পরের গল্প সমাজের, রাজনীতির। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রীনা অসুস্থ অবস্থায় কালাচাঁদের সম্মুখীন হয়। কালাচাঁদ তখন কৃষ্ণস্বামী। দুজনেই দুজনকে চিনতে পারে এবং নিজেদের হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথা জানতে পারে। ধর্মপ্রাণা রীনা আজ চরম অধর্মের পথে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। চরম উশৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত সে। চরম অভিমানে আর কষ্টে নিজেকে শেষ করে দিতে চায় সে। কৃষ্ণস্বামী কে সে জানায় তার বাবার চরম লালসার কথা, নিজের আয়া কে সে মায়ের সম্মান দিতে চেয়েও ব্যর্থ হওয়ার কথা, তার বাবার তার জন্ম পরিচয় জানিয়ে ক্লেটনের সাথে বিয়ে ভেঙে দেবার কথা আর সব থেকে বড় কথা কালাচাঁদ কে ঠকানোর কথা। সে আসলে খ্রীষ্টান ই নয় তার জন্য কালাচাঁদ কে ধর্মত্যাগ করানোর কথা। এই যন্ত্রনা বুকে নিয়ে সে নিজেকে এক জঘন্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো কথায় সে আর ফিরবে না, কালাচাঁদের এই সন্ন্যাস তার জন্য  আক্ষেপে তার মন ভরে যায়।
         গল্প এবং সিনেমা দুটোর পার্থক্য এখানেই। ধর্মের এত সুন্দর ব্যাখ্যা বোধহয় খুব কম গল্পতেই পাই।  আর ভালোবাসা! এত পবিত্র ভালোবাসা খুব কম জনের জীবনেই আসে। রীনার কথায় "  তুমি আমাকে আশীর্বাদ করেছিলে কৃষ্ণেন্দু, আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলে, সেটা এলো ওর মধ্যে দিয়ে। তুমি সেইন্ট কৃষ্ণেন্দু! তুমি সেইন্ট।" যে 'কৃষ্ণেন্দু ছিল মায়ের গোপাল। সংসারের সব জিনিসেই ছিল তার অগ্র-অধিকার। সে নিতেই জানতো, দিতে জানতো না।  শেখেনি। প্রথম দিতে শিখলো রীনার হাতে নিজেকে দিয়ে ''তার ভালবাসা" থাক রীনার কথা। তার মঙ্গল হোক। তার কথা ভাবতে ভাবতে সময়ে সময়ে মনে হয় রীনা তাকে নিজেকে দেয় নি, তার বদলে ফিরিয়ে দেবার সময় তার ঈশ্বরকে দিয়ে নিজে কাঙাল হয়ে গেছে। ঈশ্বর তার মঙ্গল করুন। যে ঈশ্বর, তার জীবনের কবরখানকে জীবন্ময় করে তুলে তুমি নতুন করে জাগো। মানুষের প্রাণশক্তির শুভবুদ্ধি, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকার আলো, ঈশ্বর তুমি জাগ্রত হও। তোমার হাতে  রীনাকে সমর্পণ করে কৃষ্ণস্বামী নিশ্চিন্ত।'" শুনেছিলেন ভগবান । কৃষ্ণস্বামী কুষ্ঠ রোগীর সেবা করতে করতে একসময়ে নিজে আক্রান্ত হয়। এবং রীনার জীবনে ক্লেটন ফিরে আসে।

রিভিউটি লিখেছেনঃ পায়েল মুখার্জি

Post a Comment

0 Comments