বইয়ের নাম: আদালত মিডিয়া সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসি।
লেখকদের নাম: দেবাশিস সেনগুপ্ত, প্রবাল চৌধুরী, পরমেশ গোস্বামী।
প্রকাশনা : গুরুচন্ডালি।
বইয়ের প্রকার: গবেষণাধর্মী।
মূল্য: ১১০ টাকা (ভারত)।
প্রচ্ছদ: কৃষ্ণেন্দু চাকী। এমনিতে সাদামাটা প্রচ্ছদ টিতে রয়েছে এক সাহসী এবং দৃঢ় প্রতিবাদের ভাষা।
পাঠ প্রতিক্রিয়া দাতার নাম: অয়ন ঘোষাল।
রেটিং: ৮/১০
সালটা 1990। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকা ভবনীপুরের আনন্দ এপার্টমেন্টে ঘটে গেল এক মারাত্মক ঘটনা। খুন হলো 15 বছরের মেয়ে হেতাল পারেখ, তার নিজের ফ্ল্যাট এ। ময়নাতদন্তে জানা গেল ধর্ষিতও হয়েছে সে। আজ থেকে 32 বছর আগে এমন একটা ঘটনা সাঙ্ঘাতিক ভাবে দাগ কেটে গেল জনগণের মনে। কিন্তু এই তো সব ঘটনার শুরু। দ্রুত গ্রেফতারের দাবি উঠলো আততায়ীর। প্রশাসন নড়েচড়ে বসলো, এবং পুলিশী তৎপরতায় তিনমাসের মধ্যেই ওই এপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ড ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় কে হেতাল খুন ও ধর্ষণের দায়ে তার গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করলো পুলিশ। আবার আলোড়ন জনতার মধ্যে, এত দ্রুত খুনির গ্রেফতারে প্রশাসন অনেক বাহবা কুড়োলো, দাবি উঠল ফাঁসির। আদালতে প্রমাণ হল, সেইই অপরাধী, ফাঁসির আদেশ দিল আদালত। অনেক আর্ত অনুরোধ জানালো ধনঞ্জয়, তার স্ত্রী ,দাদা, বাবা। হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টে সব আপিল বাতিল হয়ে গেল। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এর স্ত্রী স্বয়ং ফাঁসির দাবি জানালেন, রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদনও হল খারিজ। বাঁকুড়ার গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে ধনঞ্জয়ের ভাগ্যে কল্লোলিনী কলকাতা অভিশাপ রূপেই এলো। 14 বছর কারাবাসের পর নীচ থেকেও নীচতর অপরাধে ফাঁসি হলো তার, 2004 সালে। একুশ শতকের ভারতে প্রথম ফাঁসি হলো যার, মৃত্যুর পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত সে বলেছে সে নির্দোষ।
তার এবং তার পরিবারের সেই আর্তি অনেকের মনেই ঝড় তুলেছিল, সেই দলে ছিলেন ইন্ডিয়ান স্টেটিস্টিকেল ইনস্টিটিউট এর তিন অধ্যাপক ও। মনের ভিতর খটকা, তাঁরা ভাবলেন ঘটনা প্রবাহের আরও নিখুঁত বিশ্লেষণ দরকার। গবেষণা শুরু করে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে আবিষ্কার করলেন তাঁরা, লিপিবদ্ধ করলেন সেইসব খুঁটিনাটি। সৃষ্টি হলো এই অভূতপূর্ব গ্রন্থ। বইটির পরতে পরতে ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ সৃষ্টি করেছে এক টান টান উত্তেজনা, যা বাঘা বাঘা বিদেশি গোয়েন্দা উপন্যাস কেও হার মানায়। তাঁদের নিরলস পরিশ্রমে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ধনঞ্জয় ছিল পরিস্থিতির শিকার, রাগ দুঃখ কান্না চাপতে হয়েছে অনেক কষ্টে। বই পড়া শেষ করে মনে হলো কানে বাজছে ধনঞ্জয়ের পরিবারের উদ্দেশ্যে সমাজের বিনীত নিবেদন:"ক্ষমা করো"।
এমন বই বিরল, যেখানে ঘটনার উল্টোপিঠ এর উপর গবেষণা করা হয়েছে কেবলই মানবিকতার খাতিরে। তাই বিষয়বস্তুর নিজস্বতাতেই বইটি তার পৃথক জায়গা করে নেয়, উপর্যুপরি রূপে রয়েছে লেখার সাবলীল ভঙ্গি, আর গুরুচন্ডালি প্রকাশনার বাহুল্য বর্জিত পরিবেশনা। প্রচ্ছদ টিও আলাদা ভাবে পাঠককে আকর্ষণ করে। গবেষণার খাতিরে অনেক তথ্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছে, কিন্তু তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাদা কালো ছবি ঘটনার প্রেক্ষাপটকে আরো উজ্জ্বল করেছে। সব মিলিয়ে বইটি হয়ে উঠেছে জমজমাট।
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।