রুকু সুকু || সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় Ruku Suku pdf & Review

রুকু সুকু || সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় Ruku Suku pdf & Review

রুকু সুকু
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কৈশোরের কাহিনী নিয়ে লেখা রুকুসূকু সিরিজের একটি অন্যতম গল্প। এই পর্বের কাহিনীগুলোর অনেক সময় আলাদা নাম থাকে না। প্রধান চরিত্র দুই ভাই। তাদের নামে আলাদা আলাদা করে গল্পগুলি চিহ্নিত হয়। রুকসুকু দুই ভাই, ডাল্টনগঞ্জের এক প্রবাসী বাঙালি পরিবার; ডঃ মুখার্জি পরিবারের গৃহকর্তা; রাজ্যেশ্বরী গৃহকর্ত্রী। কিশোর দুই ভাই পিঠোপিঠি, রুকু ও সুকু। এই বৃত্তটিকে নিয়ে নানা রঙে রঙিন অনেকগুলি কাহিনী লিখেছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত একটি কাহিনী নিয়ে এখানে আলোচনা করা যাক।
এই গল্পের বৃত্তটির মধ্যে দুটি মানুষ এসে প্রবেশ করেন। তাদের নিয়েই এই গল্পের পরিণাম।
গত শতাব্দীর মধ্যবিত্তের শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠা পরিবারটির গল্প বলেন সঞ্জীববাবু। আলাদা করে কোনো কাহিনী নেই, কেননা প্রতিদিনের জীবন কাহিনীই তো এখানে গল্পের বিষয়। তাই বাড়ির ডাক্তারী শাস্ত্রে মগ্ন কর্মব্যস্ত দায়িত্ববান গৃহকর্তা, তাঁর সংসার সামলানো দশভুজা স্ত্রী রাজ্যেশ্বরী এবং এক অনন্ত সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বেড়ে ওঠা দুই কিশোর সন্তান। তাদের প্রতিদিনের ছোটখাটো সুখ দুঃখ অভিজ্ঞতা বিস্ময় কৌতূহল ইত্যাদির বর্ণময় মুহূর্তগুলি নিয়ে জীবনের মালা গেঁথে চলেন লেখক। সেখানে আসে জিভ বের করা বিশ্বস্ত কুকুর অ্যালবার্ট, যে সমস্ত পারিবারিক জমায়েতে উপস্থিত থেকে নিজেকে পরিবারের সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে, আদুরে বেড়াল শেলি, বাড়ির লোক হয়ে যাওয়া অনুগত সেবক দুখিয়া, যে সব সময় বাড়ির ছোট ছেলের দুষ্টুমির জ্বালায় অস্থির। বড় ভাই রুকু সেখানে ধীর স্থির ভালোমানুষ শান্ত প্রকৃতির, আর ছোট সুকু ছটফটে দুষ্টুমি মাখানো চরিত্র; অথচ দুই ভাইয়ের মধ্যে বন্ধন অটুট।  আসলে বন্ধন এখানে গোটা পরিবারেরই, তাই প্রতিদিনই পড়াশুনা খেলাধুলো দুষ্টুমির মধ্যে দিয়ে জীবনের নানা শিক্ষায় বেড়ে ওঠা কৈশোরের গল্প পাঠক মাত্রেরই খুব উপভোগ্য হয়, কেননা এ গল্পের মধ্যে বিভিন্ন মুহূর্তে প্রতিটি পাঠক নিজেকে খুঁজে পান, এমনকি বড়রাও।
রুকু সুকুর এই গল্পে পারিবারিক বন্ধনের সঙ্গে বেড়ে ওঠার পর্বে অনিবার্য শিক্ষাগুলিও যুক্ত হয়ে যায়। প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা দুই ভাই চারপাশের পাখি ফুল টাটকা সবজি, মাটির গুণ বুঝতে শেখে; স্কুলের বন্ধু মাতৃহীন অসুস্থ রেবেকাকে সুস্থ করার জন্য বাড়িতে নিজের মায়ের কাছে এনে হাজির করে সুকু; বন্ধুত্বর মধ্যে পরস্পরের প্রতি এই দায়িত্ববোধ ছোটদের কাছে শিক্ষণীয়। আবার নিজেদের প্রতিদিনের কাজগুলো, বিছানা পরিষ্কার থেকে বই গোছানো জুতো পরিষ্কারের মতো প্রতিদিনের কাজের অভ্যাস ডাক্তার পরিবারের দুই ছেলেকেও মানুষ হবার পথে অনেকখানি স্বাবলম্বী করে দেয়। আর এই সবকিছুর মধ্যে পরিবারের চারটি সদস্য এবং আনুষঙ্গিক চরিত্রগুলি নিয়ে জীবনের গল্প গড়ে ওঠে।
আকস্মিকভাবে এই পরিবারের মধ্যে আবির্ভূত হন  রত্নসন্ধানী জীবনভর রোমাঞ্চকর অভিযান করে যাওয়া দাদু। শেষ বয়সে হার্টের অসুখে নিজের অনিবার্য ভবিতব্য বুঝতে পেরে শেষবারের মতো মেয়ে জামাইকে দেখতে আসেন। মেয়ে জামাইয়ের সুখী পরিবারের মধ্যে জীবনের সবথেকে বড় রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে যান। অতএব এখানেই তাঁর শেষ শান্তির ঘুম। আর তার চিরদিনের অভিযানের সঙ্গী সাহসী মেজর বন্ধু তাঁকে অনুসরণ করেই এই বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। প্রাণশক্তিসম্পন্ন এই আশ্চর্য মানুষটি তাঁর চিরকালের সঙ্গী বন্ধুর মৃত্যুর পরে  যেন তাঁর আত্মাকে অনুসরণ করে মহাপ্রস্থানের পথে বন্ধুর হাত ধরেই পাড়ি দেন। দুটি আকস্মিক মৃত্যু জীবনের আনন্দবৃত্তে বড় হয়ে উঠতে থাকা দুই ভাইকে বড় নাড়া দেয়। বিষন্ন দুই ভাইকে চার্চের ফাদার কন্টকবিদ্ধ এক মূর্তির সামনে এনে দাঁড় করান। সেখানে দাঁড়িয়ে যেন শোক দুঃখ বিচ্ছেদের উর্ধ্বে মানব জীবনের মহিমাকে দুই ভাই নতুন করে অনুভব করতে পারে।
রুকু-সুকুর গল্পগুলির কাহিনী জুড়ে প্রতিদিনের জীবনের বর্ণনা ছড়িয়ে থাকে, আলাদা করে গল্প লেখার জন্য গল্প নয় , যেন পারিবারিক বৃত্ত থেকে কৈশোরকে জীবন চেনানোই এখানে লক্ষ্য। তবে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় যেহেতু কিছুটা আধ্যাত্মিক মনোভাবাপন্ন, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে তাঁর গভীর বিশ্বাস এই গল্পে ছায়া ফেলে। আর বর্তমান সময়ের আত্মকেন্দ্রিক ছোট বৃত্তে নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত কৈশোরকে শেখায় হাত পা মেলে মনের খুশিতে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সহজ আত্মিক যোগে বড় হয়ে ওঠার এক চমৎকার অভিজ্ঞতার কথা।

Post a Comment

0 Comments