রামের সুমতি
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তুরুপের তাস হলো মানুষের হৃদয়াবেগকে মূলধন করে গল্পের ময়দানে নামা। এই সংসারে একধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক রক্তের সূত্রে গড়ে ওঠে, অন্য ধরনের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হৃদয়ের সূত্রে গাঁথা। রক্তের সম্পর্কে ভালোবাসায় দাবি থাকে অনেক বেশি। সুন্দর হলেও তাতে চমক কম। কিন্তু যে বন্ধন কোনও প্রথার সূত্রে গড়ে ওঠা নয়, তার অভিনবত্ব মনে বেশি দাগ কাটে।
রামের সুমতি আসলে বৌদি ও দেওরের স্নেহ ভালোবাসার বন্ধনের গল্প। সৎ শাশুড়ির সন্তান রামলাল সেখানে নারায়ণীর আপন সন্তানতুল্য। এবং গল্পটি পড়তে পড়তে সন্দেহ থাকে না রক্তজাত সন্তান গোবিন্দের থেকে রামলালের প্রতি নারায়ণীর স্নেহ কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরঞ্চ কোথাও কোথাও বেশি। কৃষ্ণের আসল মা নয়, যশোদার স্নেহই পুরাণের পাতায় পাতায় উজ্জ্বল।
বিগত দুই শতাব্দীতে গ্রাম মফস্বলের যৌথ পরিবারের নানামুখী সম্পর্কের টানাপোড়েন শরৎচন্দ্রের গল্পের ইউএসপি। এই গল্পে প্রথমেই আছে দুই সৎ ভাইয়ের কথা, যার মধ্যে শ্যামলালের স্ত্রী পুত্র নিয়ে ছড়ানো সংসার আর কিশোর রামলালের কথাও, যার এখনও নিজস্ব সংসার করার বয়স হয়নি বলেই সম্পত্তি বিভাজন হয়নি। সুতরাং দাদার সংসারেই তার অবস্থান। কিন্তু অনাদরে না বরং সমাদরে। বস্তুতপক্ষে কিশোর রামলাল জানেও না বোঝেও না যে সে দাদার সংসারে অনাহুত হতে পারে। এমনটা কোনদিন হতে দেননি, নারায়ণী, যাঁর সৎ শাশুড়ি মৃত্যুর আগে কিশোরী বধূর হাতে নিজের শিশু সন্তানের দায়িত্ব অর্পণ করে দিয়ে গেছিলেন। তখন থেকেই রামলাল নারায়ণীর জ্যেষ্ঠ সন্তান তুল্য। আর যে সম্পর্ক রক্তের নয় সেই সম্পর্কেই বোধ হয় সব থেকে বেশি হারাই হারাই ভাব থাকে। আর সেখানেই বন্ধনকে চিরস্থায়ী করবার জন্য আবেগ ব্যাকুলতাও থাকে অনেক বেশি।
কিশোর রামলাল ভয়ংকর দুরন্ত ছেলে। কখনও কখনও গৃহস্থের কাছে আতঙ্কস্বরূপ। বর্গী বাহিনীর মত তার অনুগত নিজস্ব বালকের দল মিলিয়ে সর্বত্র দুরন্তপনা করে বেড়ায়। তার যাবতীয় চোট এসে পড়ে এই সংসারে। শ্যামলাল ভয়ংকর বিরক্ত অপমানিত হয়, সৎ ভাইয়ের কৃতকর্মের দায়িত্ব সে নিতে চায় না। নিজস্ব স্ত্রী পুত্র নিয়ে ঘেরা সংসারে রামলাল তার কর্তব্য মাত্র। সে কর্তব্যের মধ্যে যতটা সামাজিক চাপ থাকে ততটা হৃদয়ের টান থাকে না। কিন্তু নারায়ণী! দেবরের জন্য প্রতিমুহূর্তে উৎকণ্ঠিত চরিত্রটি স্নেহে শাসনে মমতায় পাখি মায়ের মতো দুই ডানায় এই দুর্বার দেওরটিকে আগলে রাখতে চান। কিন্তু সবসময় পেরে ওঠেন না। বৌদির জ্বর না সারলে স্থানীয় ডাক্তারকে গিয়ে অবুঝ রামলাল হুমকি দিয়ে আসে, পচা ওষুধ দিলে ডাক্তারের সে বারোটা বাজিয়ে দেবে। আর কি আশ্চর্য! তারপরে অসুখ সেরেও যায়। স্কুলের জমিদারের ছেলেকে পেটানো, পেয়ারা গাছে উঠে কাঁচা পেয়ারা ধ্বংস ইত্যাদি ভালো ভালো কাজে রামলালের আরেকজন লক্ষ্মণ ভাইতুল্য অনুগত সঙ্গী আছে। যদিও সে সম্পর্কে তার ভাইপো, নারায়ণীর সন্তান শিশু গোবিন্দলাল। এভাবেই এই সংসারটি বেশ এগিয়ে চলে।
কিন্তু এইবার সুখ দুঃখের সংসারে স্থায়ী-বিপত্তি হিসেবে হাজির হন নারায়ণীর বিধবা মা এবং শরৎচন্দ্রের গল্পের মূর্তিমান অলক্ষ্মণকে মুহূর্তে পাঠক চিনে নেন। নিজের মেয়ে জামাই নাতির সংসারে রামলালকে বহিরাগত চিহ্নিত করে নারায়ণীর মা অতঃপর উঠে পড়ে লাগেন তাকে এই সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এবং সাংসারিক কূটকচালিতে দক্ষ এই মহিলার সঙ্গে কিশোর রামলালের পেরে ওঠা সম্ভব হয় না। যে কোনও ঘটনাকে তিল থেকে তাল করে অবশেষে রামলালকে সম্পত্তিসহ পৃথগন্ন করে দেওয়ার কাজটি সুসম্পন্ন করে তিনি তৃপ্তি সহকারে জপের মালা হাতে নিয়ে ঠাকুরের সামনে বসেন। কিন্তু সত্যিই কি সত্যিকারের ভালোবাসা বিচ্ছেদের কাঁটাতারকে মানে? চিরকাল বিচ্ছেদের রক্তাক্ত মুহূর্তের তীব্র যন্ত্রণা ও তার দীর্ঘস্থায়ী প্রহরগুলিতে চলা আত্মবীক্ষণেই বোধহয় দামাল ছেলেটি অবশেষে ধীরস্থির হয়ে ওঠে, তারুণ্যের পথে পা বাড়ায়। আর যে বৌদি আসলে তার মায়েরই বিকল্প, সেই নারায়ণীও কি চিরকাল জ্যেষ্ঠ সন্তানকে সংসার সীমার বাইরে রাখতে পারবেন? বৌদি-দেওরের বা মাতা-পুত্রের অবশেষে মিলন হয়। আর শরৎচন্দ্রের গল্পের সেই ইউএসপি, যে ভালোবাসা মানুষের মুক্তি, মনুষ্যত্বের উজ্জ্বলতার স্মারক, সে আর একবার জিতে যায়।
কিছু কিছু গল্প থাকে যা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ সরল পারিবারিক গল্প মাত্র। তথাকথিত বলবার মতো বিশ্লেষণের মতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার জায়গা সেখানে কিছু বিশেষ থাকে না। কিন্তু জীবনের কিছু চিরন্তন অনুভূতিকে সত্য করে ফুটিয়ে তোলা এই গল্পগুলি পাঠক মনকে কিছুক্ষণ ভারী ভালো লাগায় আচ্ছন্ন করে রাখে। রামের সুমতি তেমনিই একটি গল্প।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তুরুপের তাস হলো মানুষের হৃদয়াবেগকে মূলধন করে গল্পের ময়দানে নামা। এই সংসারে একধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক রক্তের সূত্রে গড়ে ওঠে, অন্য ধরনের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হৃদয়ের সূত্রে গাঁথা। রক্তের সম্পর্কে ভালোবাসায় দাবি থাকে অনেক বেশি। সুন্দর হলেও তাতে চমক কম। কিন্তু যে বন্ধন কোনও প্রথার সূত্রে গড়ে ওঠা নয়, তার অভিনবত্ব মনে বেশি দাগ কাটে।
রামের সুমতি আসলে বৌদি ও দেওরের স্নেহ ভালোবাসার বন্ধনের গল্প। সৎ শাশুড়ির সন্তান রামলাল সেখানে নারায়ণীর আপন সন্তানতুল্য। এবং গল্পটি পড়তে পড়তে সন্দেহ থাকে না রক্তজাত সন্তান গোবিন্দের থেকে রামলালের প্রতি নারায়ণীর স্নেহ কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরঞ্চ কোথাও কোথাও বেশি। কৃষ্ণের আসল মা নয়, যশোদার স্নেহই পুরাণের পাতায় পাতায় উজ্জ্বল।
বিগত দুই শতাব্দীতে গ্রাম মফস্বলের যৌথ পরিবারের নানামুখী সম্পর্কের টানাপোড়েন শরৎচন্দ্রের গল্পের ইউএসপি। এই গল্পে প্রথমেই আছে দুই সৎ ভাইয়ের কথা, যার মধ্যে শ্যামলালের স্ত্রী পুত্র নিয়ে ছড়ানো সংসার আর কিশোর রামলালের কথাও, যার এখনও নিজস্ব সংসার করার বয়স হয়নি বলেই সম্পত্তি বিভাজন হয়নি। সুতরাং দাদার সংসারেই তার অবস্থান। কিন্তু অনাদরে না বরং সমাদরে। বস্তুতপক্ষে কিশোর রামলাল জানেও না বোঝেও না যে সে দাদার সংসারে অনাহুত হতে পারে। এমনটা কোনদিন হতে দেননি, নারায়ণী, যাঁর সৎ শাশুড়ি মৃত্যুর আগে কিশোরী বধূর হাতে নিজের শিশু সন্তানের দায়িত্ব অর্পণ করে দিয়ে গেছিলেন। তখন থেকেই রামলাল নারায়ণীর জ্যেষ্ঠ সন্তান তুল্য। আর যে সম্পর্ক রক্তের নয় সেই সম্পর্কেই বোধ হয় সব থেকে বেশি হারাই হারাই ভাব থাকে। আর সেখানেই বন্ধনকে চিরস্থায়ী করবার জন্য আবেগ ব্যাকুলতাও থাকে অনেক বেশি।
কিশোর রামলাল ভয়ংকর দুরন্ত ছেলে। কখনও কখনও গৃহস্থের কাছে আতঙ্কস্বরূপ। বর্গী বাহিনীর মত তার অনুগত নিজস্ব বালকের দল মিলিয়ে সর্বত্র দুরন্তপনা করে বেড়ায়। তার যাবতীয় চোট এসে পড়ে এই সংসারে। শ্যামলাল ভয়ংকর বিরক্ত অপমানিত হয়, সৎ ভাইয়ের কৃতকর্মের দায়িত্ব সে নিতে চায় না। নিজস্ব স্ত্রী পুত্র নিয়ে ঘেরা সংসারে রামলাল তার কর্তব্য মাত্র। সে কর্তব্যের মধ্যে যতটা সামাজিক চাপ থাকে ততটা হৃদয়ের টান থাকে না। কিন্তু নারায়ণী! দেবরের জন্য প্রতিমুহূর্তে উৎকণ্ঠিত চরিত্রটি স্নেহে শাসনে মমতায় পাখি মায়ের মতো দুই ডানায় এই দুর্বার দেওরটিকে আগলে রাখতে চান। কিন্তু সবসময় পেরে ওঠেন না। বৌদির জ্বর না সারলে স্থানীয় ডাক্তারকে গিয়ে অবুঝ রামলাল হুমকি দিয়ে আসে, পচা ওষুধ দিলে ডাক্তারের সে বারোটা বাজিয়ে দেবে। আর কি আশ্চর্য! তারপরে অসুখ সেরেও যায়। স্কুলের জমিদারের ছেলেকে পেটানো, পেয়ারা গাছে উঠে কাঁচা পেয়ারা ধ্বংস ইত্যাদি ভালো ভালো কাজে রামলালের আরেকজন লক্ষ্মণ ভাইতুল্য অনুগত সঙ্গী আছে। যদিও সে সম্পর্কে তার ভাইপো, নারায়ণীর সন্তান শিশু গোবিন্দলাল। এভাবেই এই সংসারটি বেশ এগিয়ে চলে।
কিন্তু এইবার সুখ দুঃখের সংসারে স্থায়ী-বিপত্তি হিসেবে হাজির হন নারায়ণীর বিধবা মা এবং শরৎচন্দ্রের গল্পের মূর্তিমান অলক্ষ্মণকে মুহূর্তে পাঠক চিনে নেন। নিজের মেয়ে জামাই নাতির সংসারে রামলালকে বহিরাগত চিহ্নিত করে নারায়ণীর মা অতঃপর উঠে পড়ে লাগেন তাকে এই সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এবং সাংসারিক কূটকচালিতে দক্ষ এই মহিলার সঙ্গে কিশোর রামলালের পেরে ওঠা সম্ভব হয় না। যে কোনও ঘটনাকে তিল থেকে তাল করে অবশেষে রামলালকে সম্পত্তিসহ পৃথগন্ন করে দেওয়ার কাজটি সুসম্পন্ন করে তিনি তৃপ্তি সহকারে জপের মালা হাতে নিয়ে ঠাকুরের সামনে বসেন। কিন্তু সত্যিই কি সত্যিকারের ভালোবাসা বিচ্ছেদের কাঁটাতারকে মানে? চিরকাল বিচ্ছেদের রক্তাক্ত মুহূর্তের তীব্র যন্ত্রণা ও তার দীর্ঘস্থায়ী প্রহরগুলিতে চলা আত্মবীক্ষণেই বোধহয় দামাল ছেলেটি অবশেষে ধীরস্থির হয়ে ওঠে, তারুণ্যের পথে পা বাড়ায়। আর যে বৌদি আসলে তার মায়েরই বিকল্প, সেই নারায়ণীও কি চিরকাল জ্যেষ্ঠ সন্তানকে সংসার সীমার বাইরে রাখতে পারবেন? বৌদি-দেওরের বা মাতা-পুত্রের অবশেষে মিলন হয়। আর শরৎচন্দ্রের গল্পের সেই ইউএসপি, যে ভালোবাসা মানুষের মুক্তি, মনুষ্যত্বের উজ্জ্বলতার স্মারক, সে আর একবার জিতে যায়।
কিছু কিছু গল্প থাকে যা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ সরল পারিবারিক গল্প মাত্র। তথাকথিত বলবার মতো বিশ্লেষণের মতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার জায়গা সেখানে কিছু বিশেষ থাকে না। কিন্তু জীবনের কিছু চিরন্তন অনুভূতিকে সত্য করে ফুটিয়ে তোলা এই গল্পগুলি পাঠক মনকে কিছুক্ষণ ভারী ভালো লাগায় আচ্ছন্ন করে রাখে। রামের সুমতি তেমনিই একটি গল্প।
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।