নির্বাচিত ছোটোগল্প
মূল গ্রন্থ — নব-নীতা
লেখক — নবনীতা দেবসেন
নব-নীতা গ্রন্থটি নবনীতা দেবসেনের বিভিন্ন ধরনের রচনা একটি সংকলন । তার মধ্যে থেকে নির্বাচিত কয়েকটি ছোটোগল্প এবারের পুস্তক সমালোচনার জন্য বেছে নেওয়া গেল।
নবনীতা দেবসেনের বিপুল পান্ডিত্য তাঁর লেখালিখিতে বৈদগ্ধ্যের দ্যুতি ছড়ায়। তাঁর কবিতা তাঁর উপন্যাস তাঁর প্রবন্ধ এর নিদর্শন। কিন্তু তাঁর লেখা কিছু গল্প, যেগুলো একেবারেই দৈনিক ঘরকন্যার অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনা এবং তার অনেকগুলিতেই ব্যক্তি নবনীতা, তাঁর মা, দুই মেয়ে, পরিচিত আত্মীয়-বন্ধু সহ পারিবারিক উষ্ণতার আমেজ ছড়িয়ে থাকে। এই গল্পগুলির মধ্যে রম্যরচনার আস্বাদন পাওয়া যায়। যেমন 'ভালোবাসা কারে কয়' গল্পটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নিজের বয়ানে নবীন প্রজন্মের কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা জানতে চাইবার সময় অজ্ঞাতেই যে অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করে কেলেঙ্কারি করে ফেলেন গল্প জুড়ে তারই মজার উপস্থিতি। ভারী মনোরম লাগে এই পাঠ! কন্যার অপরিচিত তরুণ বন্ধুর কাছে এই প্রেমের ভাষণ শুনতে গিয়ে যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় তার সরস বর্ণনা দিয়ে কাহিনী শেষ হয়। মাঝখানে থাকে নানা বয়সের নানা মেজাজের নানা ধরনের মানুষের কাছে প্রেমের সংজ্ঞা জানার মধ্যে দিয়ে যুগের মানসিকতাকে বোঝার চেষ্টা। বলা বাহুল্য, পুরো বিষয়টাই খুব সরল উপভোগ্য আকারে পরিবেশিত। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে জীবনের সম্পর্ককে নানা দৃষ্টিতে দেখার মাধ্যমে যে বিচিত্র জীবনবোধ উঠে আসে এবং বিভিন্ন জেনারেশনের দৃষ্টিতে সম্পর্কের নানা সামাজিক বিবর্তনের ছবি, তাকেও নবনীতা সুকৌশল উপস্থিত করেন। মজা হচ্ছে এটাই যে এই জীবন বোধকে খুব লঘু চালে তিনি হাজির করেন, যা নবনীতার চিরকালের অভ্যাস।
আরেকটি গল্প 'মেসোমশায়ের কন্যাদায়'। বাঙাল মেসোমশাই তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কন্যাকর্তা হয়েও সেই অর্থে কোনো কাজই করতে পারেন না। কিন্তু তিনি যে কোনো কাজের নন এটা তিনি আদৌ মানতে চান না। সব জায়গায় নিজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আদতে তিনি গোলমাল বাধিয়ে ফেলেন। সফল ছেলেমেয়েরা, কর্মদক্ষ আত্মীয়-স্বজন, এবং বিশেষ করে দক্ষ গৃহিণী সবটা সামলে দেন। কিন্তু মেসোমশাই মনে করেন তাঁর মতামত ভাবনা চিন্তাই সঠিক এবং সেটা করতে গিয়ে তিনি যেসব বেঠিক পরিস্থিতি তৈরি করেন তাতে উৎসব বাড়িতে কিছু গন্ডগোল তৈরি হয়। বলা বাহুল্য, এই গোলমালগুলি কোনটাই সিরিয়াস না। বরঞ্চ উপভোগ্য। কোথায় যেন মনে হয় এই মেসোমশাইটির মধ্যে কিছুটা স্বয়ং লেখিকা নিজেকেই উপস্থিত করেন। যে মানুষটি চেনা ছকের মধ্যে পুরোপুরি চলেন না, অথচ নিজের মর্জিমাফিক চলার স্বাধীন ইচ্ছাকে মোটেও ছেড়ে দিতে রাজি নন, নবনীতা নিজেও সেরকম একটি চরিত্র।
'পরীক্ষা' গল্পটি তাঁর মেয়েদের নিয়ে। জ্যেষ্ঠা কন্যার বোর্ডের প্রথম পরীক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতা এখানে গল্পচ্ছলে ব্যক্ত। পাঠকদের এই গল্প আরো মনোরম লাগে এ কারণেই যে প্রতিটি পরিবারেই কমবেশি এই জাতীয় অভিজ্ঞতা ঘটে থাকে। পাঠকেরা আসলে নিজেদেরই এ গল্পের মধ্যে খুঁজে পান। বাড়ির প্রথম সন্তান জীবনের প্রথম পরীক্ষায় যখন উপস্থিত হয় তখন সেটা গোটা বাড়ির পরীক্ষায় পরিণত হয়। সন্তানের পরীক্ষা যে কম বেশি অভিভাবকেরই পরীক্ষা। সন্তানের থেকে অভিভাবকেরা পরীক্ষা নিয়ে বেশি উদ্বেগে থাকেন। উচ্চশিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা মায়ের সঙ্গে যে এখানে ঘরোয়া গৃহিণী মায়ের কোনো পার্থক্য নেই কাহিনীতে সেটিই ফুটে ওঠে। সব থেকে মজার বিষয় এটাই যে এই উদ্বেগ পরীক্ষার্থীর নিজের ততটা নয় যতটা বাড়ির লোকেদের। সুখপাঠ্য গল্পটি আসলে ঘর ঘর কি কাহানি।
'মধ্যরাতের ভয়ঙ্কর' কোন রহস্য গল্প বা ভূতের গল্প না। এখানে পরীক্ষা মায়ের আর পরীক্ষক এবং শিক্ষক তাঁর বড় মেয়ে। চারচাকা চালাতে পারা মায়ের দুই চাকার বাইক চালানো শেখার ইচ্ছে এবং মধ্যরাতে কলকাতার ফাঁকা রাস্তায়, পাড়ার মধ্যে সেই বাইক চালানো শিখতে যাওয়ার পরিণাম এখানে কৌতুকের ছলে ব্যক্ত। বলাবাহুল্য শেষ পর্যন্ত ওই জেনারেশন গ্যাপকে মেনে নিয়ে পুনরায় চার চাকায় নিশ্চিন্ত প্রত্যাবর্তন।
গল্পগুলির মধ্যে বাঙালির পারিবারিক জীবনের মেজাজটি চমৎকার ধরা পড়ে। ক্রমশ নিউক্লিয়াস ফ্যামিলিতে পরিণত হওয়া বাঙালির জীবনে বছর পঞ্চাশ আগেও কী চমৎকার একটি পাড়া ছিল! রক্তের সম্পর্ক এবং রক্তের সম্পর্কের বাইরে আত্মীয় বন্ধুর দল ছিল! শুধুমাত্র নিজের কেরিয়ার গড়া আত্মসুখী জীবনের অতিরিক্ত সকলকে নিয়ে বাঁচবার এক চমৎকার পরিবেশ ছিল! নবনীতার লেখায় সেই উষ্ণ পরিবেশ আজও বড় আরাম দেয়!
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।