মতিলাল পাদরী || কমলকুমার মজুমদার Motilal Bhadhuri pdf & Review

মতিলাল পাদরী || কমলকুমার মজুমদার Motilal Bhadhuri pdf & Review

মতিলাল পাদরী  ---
কমলকুমার মজুমদার।

মতিলাল পাদরী গল্পটির মুখ্য বিষয় হল মানবতা।  মানবতা ধর্মকে ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত একধর্মমুক্ত জীবনবোধের কথা বলে। মতিলাল আদিবাসী সন্তান।  স্থানীয় চার্চের সহায়তা সে পেয়েছিল। সম্ভবত চার্চের ফাদারের হাতেই তার মানুষ হয়ে ওঠা। দরিদ্র অন্ত্যজ জীবন থেকে উঠে আসা মতিলাল ভক্তি এবং আন্তরিকতার জোরে একদিন সেই চার্চের পাদ্রী হয়ে বসে। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে পরবর্তী কাজের। সে কাজ আর কিছু নয়, খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার। যীশুর বাণীকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং নিষ্ঠার সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্মের রীতিনীতি পালন করা। সেই পালন করতে গিয়ে মতিলাল বাইবেলের প্রত্যেকটি শব্দকে অক্ষরে অক্ষরে মান্যতা দিতে শুরু করেছিল। স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে শিক্ষার ধর্মের স্বাস্থ্যের প্রচার ছাড়াও সে সেবামূলক নানা কাজে নিজেকে জড়িত রাখত। আর মতিলাল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত যিশুখ্রিস্ট পুনরায় আবির্ভূত হবেন। তিনি মানুষের সেবায় আবার নিজেকে কাজে লাগাবেন। সেই বিশ্বাস নিয়ে প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত তার কাটিয়ে দেওয়া। 

এক ঝড়ের রাতে অন্ধকারে তার চার্চে অকস্মাৎ এসে আশ্রয় নেয় এক নারী --- ভামর। সে আসন্নপ্রসবা। চার্চেই তার পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। আশ্চর্যভাবে মতিলাল এই ঘটনার সঙ্গে যিশুখ্রিস্টের জন্মের সাদৃশ্য পায়। ভামরের স্বামী ছিল না। সে ছিল বারবধূ । সে কারণে যিশুখ্রিস্টের মা কুমারী মেরীর সঙ্গে সে ভামরের মিল পায়।  তার স্থির বিশ্বাস থেকে   যিশুখ্রিস্টের আবার আবির্ভাব ঘটেছে বলে সে ধরেই নেয়।  

এরপর সে ভামর ও তার শিশুপুত্রকে চার্চে আশ্রয় দেয় । শিশুটির দায়িত্ব নিজেই নেয়  এবং ক্রমশ সে হয়ে ওঠে তার পিতা এবং অভিভাবক। সে শিশুপুত্রকে গভীরভাবে স্নেহ করতো এবং তার বিশ্বাসের কথা আশেপাশের গ্রামে প্রচার করে।  কিন্তু  ভামরের পক্ষে  কিছুতেই যিশুর মায়ের মত শুদ্ধ আত্মা হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। একসময় তার পতন ঘটে। সেই পদস্খলন দেখে আহত স্বপ্নভঙ্গ হওয়া মতিলাল শিশুটিকে ত্যাগ করতে যায়।

শিশুটির কান্নায় তার চেতনা জেগে ওঠে।  তার মধ্যে প্রবল ধিক্কার জন্মায় নিজের প্রতি । সে বোঝে যে এতদিন যিশুর আরাধনা করেও সে যিশুর ক্ষমাশীলতার কিছুই অর্জন করতে পারেনি। সে শিশুটিকে ফিরিয়ে নেয় এবং প্রকারান্তরে যেন তার কাছে ক্ষমা চায়। বলাবাহুল্য এইখানে প্রথাগত ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে মানবিক ভালোবাসাই শেষপর্যন্ত জয়ী হয়। 

কমলকুমার মজুমদারের মতিলাল পাদরী গল্পটির মধ্য দিয়ে লেখক আসলে একটি বিশেষ জীবন দর্শনকে উপস্থিত করতে চেয়েছেন। যে জীবন দর্শন শেষ পর্যন্ত নীতিশাস্ত্র বা অন্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে  মানবিকতার কথাই বলে। 

গল্পটির মধ্যে আছে যে মতিলালের কথা সে প্রান্তিক মানুষ আদিবাসী জীবন থেকে তার উঠে আসা। চার্চের ফাদারের সাহায্যে বড়ো হয়ে ওঠাড় ফলে বাইবেলের বাণী তার রক্তে অস্থি  মজ্জায় মিশে একাকার হয়ে গেছে। সে কারণে সে  বিশ্বাস করে পৃথিবীর মনুষ্যত্বের মানব সভ্যতার মুক্তিদাতা একমাত্র যীশু। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা বাইবেলের নির্দেশকে নিয়ম অনুযায়ী মানা --- এটাই ছিল তাঁর জীবন-দর্শন। প্রান্তিক জীবন থেকে উঠে আসা মানুষটিকে একটি প্রতিষ্ঠিত একটি মানুষের জীবন দিয়েছিল যে ধর্ম যে যীশুর বাণী, সেই বাণীর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস। 

গল্পটি শুরু হওয়ার সময় মতিলাল প্রৌঢ় বয়সে উপস্থিত। তার ওপরে ওই প্রান্তিক অঞ্চলের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। বোঝা যায় যে, ওই চার্চের যিনি ফাদার মতিলালকেই পরবর্তী  অধিকারী রূপে নির্বাচন করে যান।  তার নিয়ম নিষ্ঠা তার বিশ্বাস তার আন্তরিকতা ও সততার জন্য সে ব্যতিক্রমী। এই দায়িত্ব যিনি অর্পণ করেছিলেন তিনি জানতেন যে সেই দায়িত্ব মতিলাল যথার্থভাবে পালন করবে। মতিলাল তা বহু বছর ধরে নিরলসভাবে করে গেছে।  সে  পরিশ্রমী। গল্পে  দেখা যায় যে ফুল বাগানে জল দেওয়া,  চার্চের জমি পরিচ্ছন্ন রাখা, স্থানীয় মানুষদের মধ্যে নিয়মিত যিশুর বাণী প্রচার,  তাদের বিপদে আপদে পাশে থাকা এবং অন্যান্য সমাজসেবামূলক সে করেই চলে।এখানে মতিলাল চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। চরিত্রটি নিষ্ঠাবান এবং সে নিজে যেমন মানুষের সেবার মাধ্যমে যিশুর বাণীকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চেষ্টা করেছে তেমনই বিশ্বাস করেছে  স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও সেই বিশ্বাস একদিন না একদিন সঞ্চারিত হবে। যদিও স্থানীয় মানুষেরা তার মত গভীরভাবে যিশুর অনুরাগী নয়,  কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মতিলালের এই অনলস চেষ্টাকে তারা শ্রদ্ধা করে এবং এক রকমে ভালোওবাসে। মানুষের জীবনে ও মানসিকতায় কোনো বড়ো বদল হয়তো সে আনতে পারেনি।  সে তার নিজের বিশ্বাসের সারল্যের শ্রমের আন্তরিকতার জন্য আঞ্চলিক মানুষের কাছের লোক হয়ে উঠেছিল।  মতিলালের উত্তরণই গল্পের মুখ্য বিষয়।  মতিলাল মানুষ বলেই তার মধ্যে কিছু মানবিক দুর্বলতা ছিল। যিশুর বাইবেলের প্রত্যেকটি কথাকে সে অক্ষর অক্ষর জীবনে পালনীয় হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু মনের মধ্যে তারও ছিল কিছু প্রত্যাশা এবং প্রত্যাশা ভাঙতে তার ভেতরে সাধারণ মানুষের প্রতিশোধ স্পৃহা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাচ্চাটিকে অন্তর থেকে সে ভালবেসেছিল। প্রথম অভিঘাতে তাকে পরিত্যাগ করলেও বাচ্চাটির কান্না তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। সেদিন সে বোঝে যে কত বড় অধর্ম সে করছিল। জীবনের অনেক বড় প্রতারণা এবং মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে যে মানুষটি সকলকে ক্ষমা করে গেছেন তাঁকে এখনো সে অনুসরণে অক্ষম।  
প্রকৃতপক্ষে এই উত্তরণেই গল্পের মর্মসত্যটি লুকিয়ে রয়েছে । যে কোনো ধর্মেরই মূল কথা মানবসেবা মানুষকে বিশ্বাস এবং ভালোবাসা। যিশু সেই মানব ধর্ম পালন করেছিলেন এবং যিশুর অনুসরণ করে একেই জীবনের ধর্ম হিসেবে মতিলাল মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ক্ষণকালের জন্য সে বাচ্চাটিকে যে পরিত্যাগ করেছিল সেই অপরাধে সে নিজেকে ধর্মচ্যুত ভেবেছিল। বিবেকের দংশনে কাতর মতিলাল কিন্তু যথার্থই খ্রিশ্চান । কারণ আমরা জানি যে সত্যিকারের ধর্মের মর্মবস্তু মানুষকে ক্ষমা করা মানবসেবা এবং মানুষকে ভালোবাসা।

Post a Comment

0 Comments