বই- মহাভারতের প্রতিনায়ক
লেখক- নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
এই বইতে মহাভারতের সেই সকল ব্যাক্তির কথা বলাহয়েছে যাদের মধ্যে নায়ক হবার ক্ষমতা থাকা সত্যেও তারা হয়নি কারণ কোনো ক্ষেত্রে ভাগ্য / বিধাতা/ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আবার কোন ক্ষেত্রে নিজের চারিত্রিক দোষ বা নিজের অহংকার বা নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে নায়কের বিপরীতে অবস্থান করছে। আবার এটাও ঠিক এই প্রতিনায়করা না থাকলে মহাভারতের নায়করা কি নায়ক হয়ে উঠতে পারতো?
এই বইটা এমন প্রতিনায়কদের নিয়ে লেখক আলোচনা করেছে, কোন পরিস্থিতি তে তারা এই জায়গায় এলো তার যুক্তিযুক্ত আলোচনা করেছেন।
1) একলব্য নিষাদ
একলব্য গুরু দ্রোনকে নিজের শিক্ষাগুরু করার জন্য তার কাছে এলে দ্রোনাচায তাকে প্রত্যাখ্যান করেন তার কারণ গুলি খুব সুন্দর ভাবে এখানে তুলে ধরেছেন লেখক।
নিম্ন বর্ণের একলব্য যদি সে ভালো ছাত্র হতো তো সে রাজপুত্রদের ঈর্ষার কারণ হতো আবার যদি বিপরীত হতো তো তাদের পরিহাসের / মস্করার কারণ হত।
যখন একলব্য গুরু দ্রোণের কাছে আসেন তিনি তখন কৌরব র পাণ্ডবদের শিক্ষা দিচ্ছেন বা বলা যায় তিনি কুরু বংশের পৃষ্ঠপোষকতা তে জীবন ধারণ করছিলেন, যদি নিম্ন বর্ণের কাউকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি এই পৃষ্ঠপোষকতা হারাতেন তাহলে তাকে আবার নিজের দরিদ্র জীবনে ফিরে যেতে হবে এই আশঙ্কা ও ছিল, তা না হলে অর্থের বিনিময়ে তিনি একলব্যকে শিক্ষা দিতে পারতেন ।
যখন পাণ্ডবরা তাদের শিকারি কুকুরের কণ্ঠস্বর কেউ তীর দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে তার খোঁজ করে তার সমন্ধে জানতে পারেন যে সেও নাকি গুরু দ্রোণের ছাত্র। সেই কথা শুনে অর্জুন তার গুরু কে বলেন যে আপনি বলেছিলেন যে আপনার ছাত্রদের মধ্যে আমি সবশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধার হবো কিন্তু তাও কি করে একলব্য এত বেশি শিখলো।
আসলে এখানে দেখানো হয়েছে যে বড় হতে গেলে মান অভিমান ছল চাতুরী শক্তি সবই ব্যাবহার করতে হয়। না হলে অর্জুন যখনই একলব্য কে আবিষ্কার করলো তখনই তাকে ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করে তাকে যুদ্ধে আহ্বান করে তাকে পরাস্থ করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে পারতো। তা না করে সে তার গুরুর কাছে অভিমান ব্যক্ত করে।
ভালো গুরু সর্বদাই নিজের ভালো ছাত্রকে একটু বেশি প্রশ্রয় বা সাহায্য করে, অর্জুনের অধ্যাবসায় দেখে গুরুদ্রোন নিজের পুত্র থেকে বেশি জ্ঞান প্রদান করেছিল এবং বলেছিলেন যে অর্জুনই তার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুরবিদ হবে, আর সেই কথা যখন অর্জুন গুরু দ্রোনকে স্মরণ করিয়ে দিল তখনই তিনি তার পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করে অর্জুন কে নিয়ে একলব্য র কাছে গিয়ে জানতে পারলেন যে একলব্য তার মূর্তি গড়ে তাকে গুরু মেনে নিজের দক্ষতায় এই জায়গায় পৌঁছেছে তাই অর্জুনের জন্য গুরুদক্ষিণা হিসাবে একলব্য র দক্ষিণ হস্থের বৃদ্ধা অঙ্গুলি টি চেয়ে নিলেন।
একলব্যর চরিত্র ও খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন যখন গুরু দ্রোণ তাকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ না করায় সে তখন দ্রোনকে প্রণাম করে ফিরে আসেন কোনো অনুনয় করেননি। ফিরে আসে তিনি গুরু দ্রোণের মূর্তি তৈরি করে তাকেই গুরু মেনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজেকে তৈরি করেন। এবং যখন দ্রোন অর্জুন কে সঙ্গে নিয়ে তার আসেন এবং গুরুদক্ষিণা চান তখন একলব্য কোন কথা না বলে গুরুদক্ষিণা দেন। হয়তো একলব্য ভেবেছিলেন গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সাথে সাথে তার গুরু হয়তো বলবেন এটা তার পরীক্ষা ছিল এবং আবার সব ঠিক হয় যাবে কিন্তু সেরকম কিছুই হয়না। দ্রোন ফিরে যাওয়ার পর একলব্য আবার ধনুক ওঠায় কিন্তু বুঝতে পারে যে দ্রুততা র দূরত্ব সে আগে অর্জন করেছিল তা আর হচ্ছেন। তবুও সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজেকে একটা সম্মান জনক যোদ্ধা তে পরিণত করে। যদিও মহাভারতে একলব্য কে নিয়ে আর আলোচনা নাই , কিন্তু লেখক এখানে কিছু তথ্য দিয়েছেন যে কৃষ্ণ বলরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করেন একসময় যখন দ্বারকা র প্রতিপক্ষরা দ্বারকা আক্রমণ করে। সে যুদ্ধে একলব্য পরাজিত হয় এবং কোনো এক দ্বীপে জীবনযাপন শুরু করে এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
2) দুর্যোধন
দুর্যোধন যাকে আমরা মহাভারতের সবচেয়ে বড় খলনায়ক ভাবি যার জেদের জন্য কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ হয়। এখানে লেখক দুর্যোধনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং কিভাবে তার চরিত্র গঠন হলো তার বর্ণনা দেওয়া আছে। দুর্যোধনের জন্মের সময়ের জন্য সে সিংহাসনের দাবিদার হয়নি কিন্তু তার পিতার সুপ্ত লালসা ধীরে ধীরে তারমধ্যে ছোট থেকেই গড়ে উঠেছে যে অন্যায় ভাবে তার পিতার রাজা হবার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং সেই একই জিনিস যেন নিজের সাথে না ঘটে তার জন্য সে পাণ্ডবদের হিংসা করে গেছের তার এই ধারণা কে মদত যুগিয়ে ছে শকুনি, দুঃশাসন ও কর্ণ। অন্যদিকে ছোট থেকেই ভীম তার ভাইদের (কুরু) খেলার ছলে জ্বালাতন করতো যা অনেক সময়ে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠত। কারণ সে ছিল অধিক শক্তিধরি। দুর্যোধন সেই ছোটবেলায় বুঝতে পারে যে ভীম কে এখনই হত্যা করতে পারলে বাকি পাণ্ডবদের জব্দ করা যাবে এবং সিংহাসনে বসা যাবে, এই মানসিক প্রতিফলন এসেছিল অবশ্যই বাড়ির বড়দের আলোচনা ও সমর্থনে এক কথায় অন্ধ পিতার লোভের প্রতিফলন । এই ছোট বয়সেই যখন তার অস্ত্র শিক্ষাও হয়নি, এই বয়সেই সে তার রাজা হওয়ার প্রতিপক্ষ যুধিষ্ঠির কে ছেড়ে ভীম কে হত্যার যে প্ল্যান করলেন তা থেকে তার প্রকৃত শত্রু চিহ্নিত করার পারদর্শীতা তা ফুটে ওঠে। যদি এই গুণ নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যাবহার না করে কুরু সাম্রাজ্যের জন্য ব্যবহার করতো তো সাম্রাজ্যের অনেক উন্নতি হত । সেই ছোট বয়সেই সে ভীমকে হত্যার যে প্ল্যান করেছিল তা থেকে তার রাজ গুণের পরিচয় পাওয়া যায়, যে রাজা যা করছেন র যা ভাবছেন করবেন বলে, তা তার বাইরের চেহারায় যেন প্রকট হয়ে না ওঠে। এই গুন যেকোনো রাজার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ যা দুর্যোধনের সহজাত গুণ ছিল। বিষ মেশানো খাবার খাইয়ে ভীমকে গঙ্গায় ফেলে দিলেন এবং কাউকে কিছু বুঝতে দিলেন না। এবং এখান থেকেই কুরুরাজ্যে দুটো লবি তৈরি হলো পঞ্চপাণ্ডব র তাদের আপ্ত সহায়ক বিদুর র অন্যদিকে দুর্যোধন- শকুনি-কর্ণর এদের উপর প্রচ্ছন্ন সমর্থনদাতা স্বয়ং রাজা ধৃতরাষ্ট্র। এই কার্যের দ্বারা রাজনৈতিক দাবার আসরে দুর্যোধন প্রথম দানেই বাজিমাৎ করতে না পারলেও, প্রতিপক্ষকে তিনি ডিফেন্সে খেলতে বাধ্য করলেন।
এরপর পাণ্ডব - কৌরবদের অস্ত্র শিক্ষা শুরু হলো যেখানে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে বেরিয়ে এলো অবিসংবাদী বীর হাসবে অর্জুনের উদয়।অস্ত্র শিক্ষার আগে ভীম ছিল কৌরবদের মাথাব্যাথের কারণ আর অস্ত্র শিক্ষার পরে অর্জুন ও অন্তর্ভুক্ত হলো।
এরপর অস্ত্রশিক্ষার আসরে ভীম ও দুর্যোধনের মধ্যে গদাযুদ্ধ দেখে গুরু দ্রোন বুঝলেন যে ভীম শক্তিশালী হলেও অজেয় নয় তাই তিনি সেই যুদ্ধ অমীমাংসিত ভাবে শেষ করলেন। দুর্যোধন ও কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন যে ভীম কে আটকানো যাবে কিন্তু অর্জুনের বান কখন কোনদিকথেকে ছুটে আসবে কৌরবদের দিকে তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলেন।
ঠিক তখনই অর্জনের অস্ত্র বিদ্যার কৌশল দেখে সবাই যখন মুগ্ধ তখনই আবির্ভাব হলো কর্ণের সেও অর্জুনের মতো সমস্ত কার্যকলাপ দেখালো যা দেখে দুর্যোধন উল্লাসে কর্ণকে আপন করে নিয়ে বলেন সে আজ থেকে কুরু বংশের সমস্থ সুখ উপভোগ করতে পারবে, এর কারণ অর্জুন নিয়ে যে চিন্তা ছিল তা কর্ণ দূরকরে দিয়েছে পরশুরামের কাছথেকে শিক্ষা নিয়ে এসে। এর পর কর্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে আওহাবান করলে কৃপাচায কর্ণের বংশ মর্যাদা তুলে তাকে বিরত করেন, যা অন্যায়, কারণ দুই যোদ্ধের মাপকাঠি বীরত্বই হতে পারে র কিছু নয়, কিন্তু কৃপাচাযর কাছে র কোনো উপায় ছলনা কারণ এএক্টু আগে ভীম এর দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ ব্যাক্তিগত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল এবং আবার তা যদি অর্জুন ও কর্ণের মধ্যে হতো তাও খারাপ হতো। কিন্তু দুর্যোধন আবার এগিয়ে এলো কর্ণের এই অপমানের বিরুদ্ধে এবং তাকে অঙ্গরাজ্য দান করে তার রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করলেন, যদিও এর মধ্যে মহানুভবতা না যতটা ছিল তার থেকেও বেশি ছিল নিজের স্বার্থসিদ্ধি কারণ অর্জুনের যোগ্য প্রতিপক্ষ পাওয়া গেছে। এবং এর পর যখন ভীম কর্ণকে পিতৃত্ব হীনতার জন্য অপমান করলো দুর্যোধন তার উত্তর দিতে গিয়ে পাণ্ডবদের এবং দেব দেবী দের পিতৃপরিচয় তুলে তার উত্তর দিলেন, এমন কি দ্রোন, কৃপাচায এদের ও টেনে আনলেন। যদিও এত কিছুর পর সেদিন সূর্যাস্ত হয়ে যাওয়া সেদিনের মতো এই যুদ্ধ র হলোনা।
কিন্তু শিক্ষা পর্বের পর গুরুদক্ষিণা হিসাবে ধ্রুপদ রাজাকে ধরে আনতে গিয়ে কৌরবরা এবং কর্ণও পারলেননা। কিন্তু পাণ্ডবরা অর্জুনের সাহায্যে তা করে দেখল এবং এতে পাণ্ডবদের মর্যাদা বাড়লো এবং একবছরের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ ঘোষণা করা হলো। যুবরাজ হবার পরে যুধিষ্ঠির অর্জুন আর ভীমের সাহায্যে কুরুরাজ্যের সীমানা ও সমৃদ্ধি ওর বাড়িয়ে তুললো। যাতে প্রজারা খুশি হলেও ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের এই সুখ সমৃদ্ধি সহ্য করতে পারলেন না আর যার প্রতিফলন দেখা গেল দুর্যোধনের মধ্যেও। তাই দুর্যোধনের প্ল্যান পাণ্ডবদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার তাও সমর্থন করলেন যদিও তার চিন্তা ছিল বিদুর কে নিয়ে কিন্তু দুর্যোধন বুঝিয়ে ছিল যে বিদুর পাণ্ডবপক্ষপাতী হলেও তিনি এক কিছু করতে পারবেন না, কারণ ভীষ্ম- দ্রোন- কৃপাচায এরা কুরু রাজার বিরোধ করবেননা। তার যে এই রাজনৈতিক দূরদর্শীতা তার পিতার ও ছিলোনা। কিন্তু দুর্যোধন প্রচন্ড তাড়াহুড়ো করে সব কাজে ,কোনো কিছু কে ধর্য্য ধরে করতে পারেন না। তাই বারাবনিতে পাণ্ডবদের পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন পিতার সহায়তায় সেখানে জাতুগৃহ তৈরি করলেন তাদের পুড়িয়ে মারার জন্য, কিন্তু যে বিদুরকে তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেননি তিনিই পাণ্ডবদের সেখান থেকে উদ্ধার করেন এবং কেউ কিছু বুঝতে পারলো না, সকলেই যখন ধরে নিলো পাণ্ডবরা মৃত তখন তারা ছদ্মবেশে দ্রৌপদীর সয়ম্বরে সভাতে গিয়ে অর্জুন তাকে বিবাহ করলো। এদিকে ধিতরাষ্ট্র বাধ্য হলো পাণ্ডবদের ফিরিয়ে এনে তাদের অর্ধেক রাজ্য দিতে যদিও তা বসবাসের অযোগ্য তথাপি পাণ্ডবরা সেখানে গড়ে তুললো ইন্দ্রপ্রস্থের মতো উৎকর্ষ রাজভবন। সেখানে যুধিষ্ঠির রাজসূয যজ্ঞ করলো র তাতে দুর্যোধনকে আমন্ত্রণ করে, তাকে দায়িত্ব দিলো সমস্থ রাজারা যা ভেট আনবে তার সংগ্রহ করার। এই যজ্ঞ র আগে এবং ঐ সময়ে শিশুপাল ও জরাসন্ধ হত্যার ফলে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হলো যা দুর্যোধন অনুধাবন করতে পারলেননা, সে তখন পাণ্ডবদের প্রতিপত্তি দেখে ঈর্ষায এতটা কাতর হয়ে পড়লযে নিজের রাজ্যে ফিরে আসে সে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ল র তার থেকে বেরোনোর জন্য মামা শকুনি পরামর্শে পিতা ধিতরাষ্ট্র কে মানিয়ে পাণ্ডবদের পাশা খেলায় আমন্ত্রণ করে এক একে তাদের কাছথেকে সর্বস্ব কেড়ে নিল এবং দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ এর মত কাজ করে ফেললো। কিন্তু গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্র র আশীর্বাদে পাণ্ডবরা আবার সব ফেরত পায় ফিরে যেতে লাগল দুর্যোধন ভয়পায় এতে এবং আবার তাদের পাশা খেলায় আহবান করে তার পিতার সহায়তায় যে যারা হারবে তারা ১২ বছর বনবাসের ১ বছর অজ্ঞতবাস , এবং অজ্ঞতবাস এর সময় দেখতে পেল আবার ১২ বছরের বনবাস। আবার পাণ্ডবরা হেরে যায় এবং বনবাসে চলে যায়। দুর্যোধন পাণ্ডবদের বনবাসের দুর্দশা দেখতে ও তাদের ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তি দেখতে যেখানে পাণ্ডবরা বনবাস কাটাচ্ছে সেখানে উপস্থিত হয় কিন্তু গন্ধর্ব রাজার হাতে পরাজিত হয়ে বন্দি হয়। পরে যুধিষ্ঠির এর আদেশ অর্জুন ও ভীম তাদের উদ্ধার করে এবং দুর্যোধনকে তিরস্কার করে ছেড়ে দেয়। এর পর বারো বছর অতিক্রান্ত হয় যায় এবং পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় তাদের খুঁজে পেতে অসমর্থ হয় দুর্যোধন এবং সেই সময় দুর্যোধন মৎস্য রাজ্যের পরাক্রমী সেনাপতি কীচক এর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মৎস্যদেশ আক্রমণ করে এবং অর্জুন ছদ্মবেশে তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের হারিয়ে দিয়ে পালাতে বাধ্য করে।
পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের পর তারা কৃষ্ণকে দূত হিসাবে পাঠিয়ে নিজেদের রাজ্য ফেরত চায় এমনকি অন্তত পাঁচটা গ্রাম চায় কিন্তু দুর্যোধন বিনা যুদ্ধে কিছুই দিতে চায়না এবং কৃষ্ণকে বন্দিও করতে চায় এবং অসফল হয়।
যুদ্ধ যখন নিশ্চিত তখন এই যুদ্ধে সে ভীষ্ম দ্রোন কৃপাচায এরা তার পক্ষে যুদ্ধে যোগদিলেও দুর্যোধন তাদেরকে ভরসা করতে পারেন তার বিশ্বাস খালি কর্ণই তার পক্ষে থেকে পাণ্ডবদের পরাজিত করবে। যুদ্ধে ভীষ্ম দ্রোন দুঃশাসন এর মৃত্যুর পর যখন কর্ণের ও মৃত্যু হয় তখন দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের জলের নিচের লুকিয়ে থাকে, পাণ্ডবরা সেখানে এসে তাকে সেখান থেকে বেরিয়ে এই যুদ্ধ সমাপ্ত করতে বলেন যুধিষ্ঠির। দুর্যোধন এখানে বলেন যে এই শ্ৰী হীন রাজ্য তিনি আর চান না । যুধিষ্ঠির তাকে প্রস্তাব দেয় যে সে যেকোনো অস্ত্র নিয়ে পাণ্ডবদের যেকোনো একজনের সাথে যুদ্ধ করে এই যুদ্ধ সমাপ্ত ঘটাতে। এই প্রস্তবে কৃষ্ণও যুধিষ্ঠির উপর ক্রুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু দুর্যোধন তার প্রতিপক্ষ ভীমকেই বেছে নিয়েছিলেন। যুদ্ধের জন্য দুর্যোধন পাণ্ডবদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে কুরুক্ষেত্র র দিকে যাচ্ছিলেন তখন তার আচরণ দেখে মনেই হয়নি তিনি তার শত্রুদের দ্বারা ঘিড়ে আছেন, যেন তিনি যুদ্ধ জয় করে ফিরছেন, যা দেখে দেবতার তার জন্য পুষ্পবৃষ্টি করেছে। দুর্যোধন ও ভীমের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়না ক্রমাগত চলতে থাকে কৃষ্ণ অর্জুনের দ্বারা ইশারা করে উরু ভঙ্গের কথা ভীম কে মনে করিয়ে দিয়ে অনৈতিক ভাবে দুর্যোধন কে পরাস্ত করে, তা নাহলে তাকে পরাস্থ করা অসম্ভব ছিল। দুর্যোধনের পাণ্ডবদের প্রতি ঈর্ষা ও ক্রোধ ছিল যে কুরুক্ষেত্র মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করতে করতেও সে পাণ্ডবদের মৃত্যুর ষড়যন্ত্র করে অশ্বত্থামার সাথে।
3) কর্ণ
কর্ণকে আমরা একটি ট্র্যাজিক চরিত্র হিসাবেই জানি কিন্তু এখানে তার দোষ গুলোও বর্ণিত হয়েছে।
কর্ণ জীবনে দুই রমণী দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। জন্মলগ্নে জননী কুন্তীর দ্বারা, যদিও তখনকার দিনে কানীন সন্তান নিয়ে সমাজ খুব একটা মাথা ঘামাতনা কিন্তু কুন্তী যেহেতু দত্তক কন্যা ছিল তাই তার দত্তক পিতা কি ভাবে বিষয় টা নেবে তা ভেবে তিনি কর্ণকে ত্যাগ করে র তার ফল কর্ণকে সারাজীবন ভুগতে হয় , সে যোগ্য হওয়া শর্তেও প্রতি পদে তাকে তার জন্ম পরিচয় তুলে তাকে অপমান করে তার যোগ্য সম্মান / অধিকার থেকে বঞ্চিত করাহয়। গুরু দ্রোন তাকে ব্রহ্মাস্ত্র দিতে অস্বীকার করে তার পরিচয় তুলে, কিন্তু কারণ ছিল অর্জুনের প্রতি দ্রোণের প্রীতি , তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কর্ণ এটা অর্জুনের বিরুদ্ধেই ব্যাবহার করবে। এই পরিচয় যন্ত্রনার জন্য পরশুরামের কাছে নিজের পরিচয় গোপন করেন কর্ণ কিন্তু সেখানেও সে অভিশাপগ্রস্ত হয়ে ফিরতে হয়। পাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্র পরীক্ষার সময়ে কর্ণ নিজের বীরত্বের পরিচয় দিয়ে অর্জুনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে চাইলে তাকে সেখানে উপস্থিত সকলেই তার জন্মপরিচয় নিয়ে অপমানিত করে তাকে বিরত করতে চেষ্টা করে তখন দুর্যোধন নিজের স্বার্থে কর্ণের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাকে অঙ্গরাজ্যের রাজা ঘোষণা করেন যা কর্ণকে অভিভূত করে এবং কর্ণ এর পর থেকে দুর্যোধনের সমস্ত অপরাধের ছায়াসঙ্গী করে তোলে। দুর্যোধনের প্রতি আনুগত্যে কর্ণ ভীষ্ম- দ্রোন-বিদুর সকলকেই সর্বদাই অপমান করতো। যদিও কর্ণ পাণ্ডবদের ছল চাতুরী তে পরাস্থ করার বিপক্ষে ছিল। কর্ণের যৌবনকালে তাকে আরেক নারী দ্রৌপদী পরিত্যাগ করেন তার সয়ম্বর সভায় তার জন্মপরিচয় নিয়ে আর এই পরিত্যাগের ফলে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় কর্ণের অন্তরে তা বহিঃপ্রকাশ হয় পাশ খেলায় যুধিষ্ঠির এর দ্রৌপদীকে পনে হেরে যাওয়ার পর, এর আগে পর্যন্ত কর্ণ এই পাশ খেলার চক্রান্তের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু দ্রৌপদী প্রসঙ্গ আসতেই কর্ণর সেই ক্ষোভ বেরিয়ে আসে এবং তার এই প্রচ্ছন্ন সমর্থনে দুঃশাসন ও দুর্যোধন ও দ্রৌপদীকে চরম অপমান করে তার বস্ত্রহরণে র চেষ্টা করে।কুরুক্ষেত্র র যুদ্ধের আগে কৃষ্ণ কর্ণকে তার জন্ম রহস্য জানিয়ে তাকে পাণ্ডব পক্ষে আসতে বলে এবং তাকে যে পাণ্ডবরা মাথায় করে রাখবে সিংহাসনে ও তাকেই বসাবে , কিন্তু কর্ণ নিজের ব্যক্তিত্ব অক্ষুন্ন রেখে তা প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে দুর্যোধন তাকে সম্মান দিয়েছে তার খারাপ সময়ে পাশে ছিল , এখন তার প্রতিদানের সময় পলায়ন করা উচিত নয়, যে দুর্যোধন তার ভরসায় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নামতে চলেছে তাকে ছেড়ে যাওয়া তার ধর্ম নয়। এবং কুন্তীও এই একই প্রস্তাব নিয়ে কর্ণের কাছে এলে কর্ণ তাকেও ফিরিয়ে দেন , যে মাতা কে তিনি এতদিন ধরে খুঁজেছেন তিনি সামনে এলেও এতদিনের ক্ষোভে ও অপমান তাকে সেই মায়ের কাছে যেতে বাধা দেয়, যদিও তিনি বলেন যে যুদ্ধের পর ও তার পাঁচ পুত্র জীবিত থাকবে অর্জুন বা তাকে নিয়ে। কর্ণের এই প্রস্তাব প্রত্যাখানের ওর একটি কারণ হলো যে যাদের তিনি বরাবর ঘৃণা করে এসেছেন এবং যে অর্জুনকে যুদ্ধে হারানোর জন্য তিনি এত কিছু করেছেন তাকেই বা তাদেরকেই আজ নিজের ভাই বলে মেনে নিয়ে তাদের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় এমনকি যে দ্রৌপদীকে চুড়ান্ত অপমান করেছেন তিনি তার ভ্রাতৃ বধূ তা মেনে নেওয়া কখনো সম্ভব নয় ।কর্ণর সাথে ভীষ্মর সম্পর্ক এত খারাপ হয়েযায় যে যতদিন ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন কর্ণ যুদ্ধে আসেননি বা ভীষ্মও চাননি যে কর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে আসুক। ভীষ্ম শরশয্যায় গেলে কর্ণ যুদ্ধে যোগদেন , কিন্তু আগের রাতে কর্ণ ভীষ্মর কাছে এসে ভীষ্মর প্রতি তার ব্যাবহারের জন্য ক্ষমা চায় তখন ভীষ্ম কর্ণকে বলেন যে তিনি জানতেন কর্ণর পরিচয় এবং কর্ণকে তিনি যথেষ্ট স্নেহ করেন কিন্তু নিজের ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য তিনি তাকে এত কথা শোনাতেন এবং তিনি কর্ণকে বলেন যে নিচু শ্রেণীর কোনো ব্যক্তি যদি অধিক ক্ষমতার অধিকারী হয় তখন সমাজ তা মেনে নিতে পারেনা তার কৃতিত্ব কে সম্মান না জানিয়ে তাকে সর্বদা ছোট করার চেষ্টা করে এবং এটাই কর্ণর সাথে হয়েছে। আর যে পরিবেশে কর্ণ পালিত হয়েছে তার প্রভাবেই কর্ণ নিজেকে প্রমাণ করার জন্য অর্জুনকে তার প্রতিদ্বন্ধি ভেবে এসেছে কারণ অর্জুনকে সবাই মহান ধনুর্ধর মনে তাই কর্ণ অর্জুনকে পরাস্থ করে নিজের পরিচয় তৈরি করতে চেয়েছিল। যুদ্ধে কর্ণ সেনাপতি হয়ে তার বহু প্রতীক্ষিত মুহূতে আসেন এবং অর্জুনের সাথে তার যুদ্ধ শুরু হয় কিন্তু তার জীবনে অর্জিত অভিশাপ গুলো একইসাথে ফলতে আরম্ভ করে তার রথের চাকা মাটিতে বসে যায় সে তার অস্ত্র শিক্ষা সেই মুহূর্তে ভুলে যায় এবং কৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুন তাকে হত্যা করে।
কর্ণের জন্ম ও মৃত্যু দুটোই বড় ট্র্যাজিক কিন্তু তার বাকি জীবন সে তার জন্ম পরিচয় থেকে বড় হওয়ার জন্য যে পথ তিনি নেন তা তাকে অনেক ছোট করে তোলে তার এই জন্ম পরিচয় ঠিক থাকলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়তো হতো না বা কর্ণ যদি দুর্যোধনের সাথে না থাকতো তো দুর্যোধন এই যুদ্ধে নামতো না
3) দুঃশাসন
কিছু মানুষ থাকে যাদের একক ভাব উপস্থিতি বোঝা যায়না , কিন্তু কোনো দলের বা গোষ্ঠীর সাথে থাকলে তারাই এমন হম্বিতম্বি করে যে সেই যেন ওই গোষ্ঠীর নেতা।
যেমন এই দুঃশাসন চরিত্রটি । সে দুর্যোধন কর্ণ ও শকুনি সর্বদা এক সাথে থাকতো সে কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা করেনি কিন্তু তাতে সর্বদা অংশগ্রহণ করেছে এবং দুর্যোধনকে খুশি করার জন্য যা তাকে বলাহয় করতে সে তার অতিরিক্ত করেছে যেমন দ্রৌপদী কে সভায় আনতে বলেছিলেন দুর্যোধন কিন্তু সে দ্রৌপদীকে চুল ধরে টেনে নেন এবং তার সাথেও অসম্মান মূলক আচরণ করেন যা তাকে করতে বলা হয়নি। এবং কৃষ্ণ শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আসে তখন সে দুর্যোধনকে ক্রমাগত বলতে থাকে যে দাদা আপনি আপনার অর্জিত সমস্থ রাজ্য সম্পত্তি সব ওই পাণ্ডবদের ছেড়ে দিন সে এইভাবে শান্তি প্রস্তাব যাতে কার্যকর না হয়। তার মৃত্যুতে দুর্যোধন দুঃখ পেয়েছিলো কিন্তু তার জন্য সে যুদ্ধে অতিরিক্ত কিছুই করে নি যেমন কোনো দলের কর্মী দলের নেতার জন্য প্রাণ দেয় তো সাধারণ শোক জ্ঞাপন ছাড়া আর কিছুই হয়না দুঃশাসনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
এ ছাড়াও এই বইতে শকুনি, অশ্বথামা, জয়দ্রত, কৃতবর্মা, শল্য, বলরাম এর কথাওএখানে বলা আছে।
585 পাতার এই বইটিতে পুরো মহাভারত তার বর্ণনা আছে এই চরিত্র গুলির মধ্যে দিয়ে। এবং খুব সুন্দর ভাবে প্রতিটি চরিত্রের মানসিক জটিলতা ও সামাজিক পরিস্থিতি র বর্ণনা দেওয়া আছে যা থেকে মানুষের ব্যাবহার কোন পরিস্থিতি তে কিরকম হতে পারে তার একটা ধারণা তৈরি হয়। অনেক সময়ই অনেক ব্যাক্তি তার সহজাত গুন গুলো বিকশিত করতে পারেনা শুধু মাত্র তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের জন্য যেখানে সে বেড়ে উঠেছে এটা খুবসুন্দর ভাবে লেখক বুঝিয়েছেন বলরামের চরিত বর্ণনার মাধ্যমে।
এই বই পরে যেমন মহাভারতের চরিত্রগুলোর গঠন ও বিকাশ বোঝাযায় তেমনি মানুষের মনস্তাত্বিক বিকাশ কতটা তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল বোঝাযায়। এবং বর্তমান যুগে এই মনস্তাত্বিক অবস্থার বিকাশ যে জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়।
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।