অশ্বমেধের ঘোড়া দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় Aswameder Ghora Review

অশ্বমেধের ঘোড়া দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় Aswameder Ghora Review

অশ্বমেধের ঘোড়া
দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়  


দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখা অশ্বমেধের ঘোড়া গল্পটি গত শতাব্দীর শেষ পর্বের ভারতের  প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত। গল্পের মধ্যে সমকালীন সময়ের মূল্যবোধের অবনমন ও বিপন্নতার তথা সামাজিক অবক্ষয়ের ছবি ফুটে ওঠে।  

গল্পটির কেন্দ্রে রয়েছে এক তরুণ দম্পতি। তাদের নাম কাঞ্চন ও রেখা । এরা এক বছর আগে বাড়ির অমতে গোপনে আইনসিদ্ধ বিবাহ করেছে। কিন্তু পারিবারিক পরিস্থিতিতে সেই বিবাহ এখনো সামাজিকভাবে প্রকাশ্য নয়।  বিবাহের এক বছর বাদে তারা ঐ  বিশেষ দিনকে বেছে নেয় বিবাহবার্ষিকী পালনের জন্য; অথচ সারা কলকাতা জুড়ে কোথাও তারা নির্জনতা পায় না। তাদের পারস্পরিক কয়েকটি নিভৃত  মুহূর্ত বা অবকাশের সন্ধানে সারাদিন ধরে তাদের যে অভিজ্ঞতায প্রাপ্তি তাই গল্পটিতে বিবৃত। 

কাঞ্চন এবং রেখা সারাদিন ধরে সমস্ত কলকাতা চষে বেড়ায়। তারা উপলব্ধি করে যে পুরনো কলকাতার ঐতিহ্য, তার জীবন-ধর্ম , তার জীবন-বোধ, তার  জীবনযাপনের ধরন অনেকখানি বদলে গেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে তারা এটা অনুভব করে যে তাদের মত নবদম্পতির জন্য কোন নিভৃত সুন্দর জায়গা এই শহরের কোথাও নেই।  এভাবেই তারা এসে হাজির হয় ময়দানে। ময়দানে ঘোড়ার গাড়ি দেখে তাদের মধ্যে এক নতুন পরিকল্পনা আসে। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তারা কিছুক্ষণ কলকাতার রাস্তায় পরিক্রমণের মধ্য দিয়ে নিভৃত যাপনের সুযোগ খুঁজে নিতে চায়। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তারা প্রথম আবিষ্কার করে যে পৃথিবীতে এখনও রোম্যান্স নষ্ট হয়নি। বৃষ্টি মুখরিত কলকাতার রাস্তায় ঘোড়াগাড়ির নিভৃত অবকাশে তারা প্রথম পরস্পরের প্রতি পরিপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে।  সুন্দর কয়েকটি রোমান্টিক মুহূর্ত তৈরি হতে হতেই কিন্তু গাড়ি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যায় । এবার গাড়োয়ান তাদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে। এর কারণ জানতে চাইলে গাড়োয়ান অত্যন্ত অশালীন মন্তব্য করে এবং জানায় যে ফুর্তি করার জন্য হোটেলের  ভাড়া তো তাদের দিতেই হবে । এতে অত্যন্ত অপমানিত হয় তাদের প্রেম। 

আহত চিত্তে প্রতিবাদটুকু না করে তারা শুধু মাথা নিচু করে চলে আসে। এভাবেই বোঝা যায় যে গল্পের মধ্যে দিয়ে লেখক দেখাতে চান, জীবনে রোমান্টিক স্বচ্ছ সুন্দর সম্পর্কগুলো কিভাবে আজকের পৃথিবীতে নিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে। 

অশ্বমেধের ঘোড়া গল্পটির মধ্যে আসলে বর্তমান জীবনে যে অধঃপতিত অবস্থান, যে  মূল্যবোধের পরিবর্তন, যে মানবতার ভঙ্গুর অবস্থা, হৃদয়বৃত্তির অবনতি সেটাকেই লেখক স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। 

কাঞ্চন এবং রেখা বৈধ ও সামাজিকভাবে স্বামী-স্ত্রী । শুধু বিশেষ পারিবারিক কারণে তারা এই সম্পর্কটি এখনো সর্বসমক্ষে আনেনি। তাই তারা নিছক প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই একত্র সান্নিধ্য উপভোগ করে । কিন্তু সেই বিবাহবার্ষিকীর দিনে তারা যখন নির্ধারিত অবকাশ যাপনের জন্য একটি মনোরম নিভৃত স্থানের সন্ধান করছিল তখনই তাদের সেই তিক্ত  অভিজ্ঞতা হয়। সেই দিন কাঞ্চন রেখার দৃষ্টি দিয়ে কলকাতাতে নতুন করে আবিষ্কার করে পাঠকও। দেখা যায় যে, পুরনো কলকাতার অনেক কিছুই বদলে গেছে। এই বদলের আড়ালেই নিহিত ছিল সভ্যতার ভেতরের মূল্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তন। তাই দুইটি নর-নারী যখন একত্রে পথ চলে তখন অজস্র কৌতুহলী দৃষ্টি তাদের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত কাঞ্চন রেখা ময়দানে ঘোড়ার গাড়ির মধ্যেই কিছুক্ষণ পরস্পরের মনোরম সান্নিধ্য পেতে চেয়েছিল। বৃষ্টি-ভরা কলকাতায় এই পথটুকু তাদের কাছে এক গভীর মধুর স্মৃতি হয়ে থাকল। কিন্তু সেই স্মৃতিকে শেষে তছনছ করে দেয় গাড়োয়ান। এই সময়টুকুর জন্য সে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে এবং তাদের নিভৃত  যাপনকে হোটেলের ঘরে একত্র বাসের সঙ্গে তুলনা করে অশালীন ইঙ্গিত দেয়। 

প্রাচীনকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ ছিল ভারতীয় রাজাদের একটি পরিচিত বিষয়। পুরাণে এর উল্লেখ আছে । সাধারণত কোন রাজচক্রবর্তী সম্রাট রাজসূয় যজ্ঞ বা অশ্বমেধ  যজ্ঞ করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেন। সুলক্ষণ যুক্ত একটি অশ্বকে স্বাধীন বিহারের পরে অবশেষে বলি দেওয়া হতো। সেইখান থেকে এর নাম অশ্বমেধ। ঘোড়াটির এই পরিণতির সাথে কাঞ্চন আর রেখার  সুন্দর দাম্পত্য প্রেমের স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনার মিল রয়েছে। এছাড়াও অশ্ব হচ্ছে ভারতবর্ষের পক্ষে পৌরুষ সাহস এবং অশেষ সৌন্দর্যর প্রতীক‌। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বারবার দেখা যায় যে অশ্বের ভূমিকা ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অশ্বের আগমন প্রথম ভারতে ঘটেছিল আর্যদের হাত ধরে । তারপর থেকেই বিজয়ী রাজাদের বীরত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে অশ্ব।  দশরথ, রামচন্দ্র এবং যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। ভারতে বহুজাতি এসে এই দেশ জয় করে নিয়ে গেছে অশ্বর পিঠে চেপে । ইংরেজদের দুশো  বছরের শাসনের ইংরেজ সেনাপতিরা অশ্বের ব্যবহার করতেন । পরবর্তীকালে দেখা যায় যে এই অশ্ব  ব্যবহৃত হয়েছে হীন নানা কাজে। আরো পরে তারা  ব্যবহৃত হচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া খাটানোর ভূমিকায় ও রেসের মাঠে। এভাবেই পুরাণের গর্বিত  অশ্বর বর্তমান দুর্দশা বা  অধঃপতন।  ঠিক সেভাবেই রোমান্টিক প্রেমের এক ধরনের অধঃপতন বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়। অতীত ইতিহাস ও পুরাণে রোমান্টিক প্রেমের মাধ্যমে নর-নারীর সম্পর্কের সুন্দর গল্প  পাওয়া যায়। সে গল্প আজ মর্যাদা হারিয়েছে। তাই কাঞ্চন রেখার বৈধ সম্পর্কের স্বামী-স্ত্রীকে একত্রে দেখলে এখানে অশালীন মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া হয়। তাদের প্রেম শেষ পর্যন্ত ওই কারণেই নিহত হয়েছে। এই নিধনে গাড়োয়ান যে ভূমিকা নেয় সেটি আসলে বর্তমান সভ্যতার জটিল মানুষের মনোভাব। সুস্থ রোমান্টিক প্রেম বর্তমান বিশ্বে নির্বাসিত, নিহত। অশ্বমেধের ঘোড়ার শোচনীয় পরিণতির সঙ্গে আজকের রোমান্টিক প্রেমের অন্তর্নিহিত মর্যাদা নষ্ট হওয়ার  ছবিটি মিলে যায়।

Post a Comment

0 Comments