আড়ালে রয়েছে সে - স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

আড়ালে রয়েছে সে - স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

আড়ালে রয়েছে সে 
-- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

ইতিহাস ভিত্তিক কিশোর পাঠ্য এই উপন্যাসটি স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর কলমে একটু নতুন ধরনের স্বাদ নিয়ে এলো। লেখকের এই জাতীয় লেখার সঙ্গে পূর্ব পরিচিতি ছিল না। স্বাদবদলের অভিজ্ঞতাটি ভারী সুন্দর লাগলো। 
সপ্তদশ শতকের বাংলাদেশ কাহিনীর প্রেক্ষাপট। দিল্লিতে মহামতি আকবর বাদশার শাসনকাল, অন্যদিকে বাংলাদেশে মাথা তুলছে স্বাধীনচারী বারো ভুঁইয়ার দল।  এর মধ্যেই বাংলাদেশে নিয়মিত পর্তুগিজ মগ জলদস্যুদের আনাগোনা। আর এই যুদ্ধবিগ্রহ ক্ষমতার লড়াই লুঠপাট শাসনতন্ত্রের পালাবদলের পটভূমিকার মধ্যে নিয়মিত চলা জীবনের স্রোত, তার সুখ দুঃখ ওঠা পড়ার অনন্তকালীন সত্য। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই সত্যকে লেখক তুলে ধরেছেন।
গল্পের মূল ঘটনা স্থিত হয়েছে যশোরে বারো ভূঁইয়ার অন্যতম মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সময় কালে। দীর্ঘদিন আকবর বাদশার সেনাপতি মানসিংহকে ঠেকিয়ে রাখা প্রতাপাদিত্যের আরেকটি বড় কৃতিত্ব বাংলাদেশের জলে জঙ্গলে মগ জলদস্যুদের অনেকখানি প্রতিরোধ করা। বাঙালির এই উত্থান সাহস রাজনীতির মঞ্চে লড়ে যাওয়ার হিম্মৎ সুশাসন এবং তাঁকে ঘিরে থাকা বাঙালি অমাত্যের দল মধ্যযুগের বাঙালির বৈভব ক্ষমতা সামর্থ্যের প্রমাণ রাখে। এ কাহিনীর মূল জায়গাটি রাজনীতি, রাজ্যপাট চালানোর জন্য যে কূটনীতি নিয়ত সতর্কতা দৃঢ় বুদ্ধি দক্ষতা দূরদর্শিতা ইত্যাদির প্রয়োজন হয় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে অবিরত টানাপোড়েন ষড়যন্ত্র লড়াইয়ের সে গল্প ইতিহাসে লেখা থাকে। কিন্তু সেই ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক ক্ষমতাতন্ত্রের ভেতরকার গল্প লেখক এখানে তুলে ধরেছেন।
ব্যক্তি প্রতিপাদিত্যের চরিত্র তাঁর পরিবার জীবনে কাছের মানুষদের জীবনে যে দুর্যোগ ঘনিয়ে এনেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বউ ঠাকুরাণীর হাট পড়ে পাঠক তা জানতে পারেন। কিন্তু ইতিহাসে এ সত্যও সমর্থিত যে শাসক হিসেবে প্রতাপ অত্যন্ত দক্ষ স্বাধীনচারী ও আত্মমর্যাদা প্রবণ ছিলেন। এখানেও লেখক তাঁর সেই চরিত্রটি তুলে ধরেছেন। মানসিংহের যশোরে পুনরায় আগমনের আগে গুপ্তচর বৃত্তির দ্বারা প্রথমে প্রতাপাদিত্যের রাজ্যের অন্তর মহলে ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা, অন্যদিকে জলদস্যু দাভীর আক্রমণ এবং ক্ষমতা ও অর্থের প্রলোভনে পা দেওয়া রাজতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ কর্মচারীর বিশ্বাসঘাতকতা, সব নিয়ে ইতিহাসের এক সংঘাতমুখর আকর্ষণীয় গল্প বলেছেন লেখক। সেখানে একদিকে প্রতাপের লৌহ কঠিন দৃঢ়তা, তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী দল, তারই মধ্যে কিছু বিশ্বাসঘাতকের সর্পিল চলন, রাজতন্ত্রের নিয়মের মধ্যে থেকেও সাধারণ জীবনে কাছাকাছি আসার প্রয়াসী যুবরাজ উদয়ের ব্যাকুলতা, এসব গল্প বড় মনোরম হয়ে ওঠে। কিন্তু তারই মধ্যে ইঙ্গিত থাকে ক্ষমতাতন্ত্রের বাইরে সাধারণ মানুষের জীবনের দুর্গতি অনিশ্চয়তা জলদস্যুদের দ্বারা বিধ্বস্ত গ্রামের পর গ্রাম, অনিশ্চয়তায় নিয়তির হাতে মানুষের আপন ভবিতব্যকে সমর্পণের করুণ চিত্র। এই দস্যুতা ও অন্ধকার সময় কাহিনীর আরেকটি বড় দিক। জলদস্যুদের দমন করতে একা প্রতাপাদিত্যই যথেষ্ট ছিলেন না, মোগল থেকে শুরু করে ইংরেজ আমল পর্যন্ত জলদস্যুদের এই অত্যাচার প্রতিরোধে সময় লেগেছে। আর তার মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। দাস ব্যবসার সেই দুঃস্বপ্নের সময়ের ইঙ্গিত এখানে পাওয়া যায়।
তবু এসব কিছুকে ছাপিয়ে কাহিনীর আসল চরিত্র হয়ে ওঠে উষ্ণীষ রায়, এক অনাথ অন্যের হাতে মানুষ হওয়া জীবনে ঘাটে আঘাটে ঘুরে বিচিত্র জীবন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মানুষ। এই সাধারণ তরুণ কাহিনীতে প্রধান ভূমিকা নেয় নিজের অজান্তে। রাজনৈতিক সংঘাতে এক একটি বিশেষ মুহূর্তে তার আকস্মিক আবির্ভাব এবং আন্তরিক সৎ মানসিকতা কাহিনীতে অনেক বিপদকে প্রতিরোধ করে, যদিও সে থেকে যায় আড়ালেই।  রাজনীতির ঘটনাজাল এক সময় তার জীবনকে বিপন্ন করে, কিন্তু শুভাকাঙ্ক্ষী জনেরা এই সৎ কর্মঠ অন্যের জন্য আত্মদানে সদা তৎপর মানুষটিকে রক্ষা করে। বন্ধনহীন এই মানুষটি শুধু সাধারণের বিপদে অন্যায়ের প্রতিরোধে নিঃশব্দে লড়াই করে চলবে আজীবন। দেশের বহমান ইতিহাসের ধারায় সে মিশে থাকবে হাজার হাজার তারই মতন কর্মপ্রবণ নামহীন নায়কের মধ্যে। কাহিনীতে এমন ইঙ্গিত দিয়েই লেখক গল্প শেষ করেন।
সনজিৎ চক্রবর্তীর এই গল্প ইতিহাসের গল্প আবার ইতিহাসে মধ্যে আর এক মর্মসত্যকেও তুলে ধরে সফলভাবে। রাজনীতির বহমান ইতিহাসের অন্তরালে অনেক দক্ষ বোঢ়ে থাকে যারা দাবার চাল বারবার বদলে দেয়। তাদের কথা ইতিহাসে আসে না, কিন্তু জনজীবনের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এইসব মানুষেরাই রাজনীতির নিগূঢ় চলনের মধ্যে ছোটখাটো অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে চলে নিঃশব্দে। এই আত্মপ্রত্যয়ী জনমানবেরাই আসলে ইতিহাসের আসল সংগঠক।

Post a Comment

0 Comments