সাদা খাম || মতি নন্দী Sada Kham pdf & Review

সাদা খাম || মতি নন্দী Sada Kham pdf & Review

 বইঃ সাদা খাম (উপন্যাস)
লেখকঃ মতি নন্দী
প্রকাশকঃ আনন্দ পাবলিশার্স
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৯০
মুদ্রিত মূল্যঃ (দিলাম না, কারণ আমি যে বইটি পড়েছি সেটি বহু পুরনো সংস্করণ; আর এখন বইটি আলাদাভাবে প্রকাশ হয় কি না, হলেও বা তার মূল্য কী, এ ব্যাপারে জানা নেই)

মতি নন্দী বলতে বহুদিন অবধি আমি জানতাম আনন্দমেলায় একের পর এক খেলা নিয়ে বেরোনো অসামান্য সব উপন্যাসের লেখক। আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে ওঁর লেখা নারান, তুলসী, ননীদা নট-আউট, অপরাজিত আনন্দ, শিবা, শিবার ফিরে আসা, বুড়ো ঘোড়া, সারথির সারথি, ফেরারি, দলবদলের আগে, স্টপার, স্ট্রাইকার, মিনু-চিনুর ট্রফি, কলাবতীর নানা উপন্যাস পড়ে বরাবরই মুগ্ধ হয়েছি। পরে ওঁর কিশোরদের জন্য লেখা গল্পসংগ্রহটিও পড়ি।

কিছুটা আকস্মিকভাবেই, বেশ কিছু বছর আগে, কোনো একটি গল্পসংকলনে মতিবাবুর একটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা ছোটো গল্প পড়ি, এবং চমৎকৃত হই। কিশোর সাহিত্যের বাইরেও  ভদ্রলোক সম্পূর্ণ অন্য যে জগত নির্মাণ করেছিলেন নিজের মায়াকলম দিয়ে, তার মুগ্ধতায় বিস্মিত হই। সেই থেকে মতি নন্দীর বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটোগল্প পড়া শুরু।

সাদা খাম মতি নন্দীর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস। এখানে ভদ্রলোকে কলমের যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, তার জাদু থেকে বেরোনো বড্ড মুশকিল। কিছু কিছু বই একবার পড়লেও সারা জীবনের মতো মনের মধ্যে দাগ কেটে যায়, এ বইটি তেমনই।

আজকাল চারিদিকেই ধর-তক্তা-মার-পেরেক টাইপের তাড়াহুড়ো। বাংলা ভাষাটা (এবং বাংলা বানান) শুদ্ধভাবে লিখতে না শিখেই লোকে ফেসবুকে পেজ খুলে লেখক হয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বই প্রকাশ হচ্ছে, সে সব বই-ই না কি বেস্টসেলার। ভাবা যায়!! সেখানে মতিবাবুর প্রথম গল্প লেখার অধ্যবসায় কি রকম? সমবয়স্ক এবং সমমনস্ক কিছু তরুণদের সাথে একটি সাহিত্যের আড্ডায় যোগ দিয়ে মতিবাবু গল্প লেখা শুরু করেন। প্রতি সপ্তাহে আড্ডার জন্য একটি গল্প লিখতেন, আড্ডায় গিয়ে সেটা পড়ে শোনাতেন; সেই গল্প নিয়ে বন্ধুরা কাটাছেঁড়া করতেন, ফিডব্যাক দিতেন। উনিও সেগুলো শুনতেন, তারপর চেষ্টা করতেন আবার পরের সপ্তাহের গল্পে সেই পরিবর্তনগুলো আনার। এই ব্যাপারটা চলেছিল প্রায় চার বছর ধরে!!! এই চারবছরে ২০৮ সপ্তাহে উনি কমপক্ষে ১৫০টি গল্প লিখেছেন, কিন্তু একটিও ছাপাননি। অবশেষে যখন ওঁর মনে হল যে, লেখা গল্পগুলো হয়তো ছাপাতে দেওয়া যেতে পারে, তখন একটা গল্প লিখে সেটাকে পকেটের মধ্যে নিয়ে ঘুরতেন। বাসে যেতে যেতে, বা অফিসে কাজ করতে করতে হঠাত যদি কিছু পরিবর্তন মাথায় আসতো, তৎক্ষণাৎ সেটা লিখে ফেলতেন। এইভাবে ছয়মাস একটি লেখাকে লালন করার পর প্রথম ছোটগল্পটি ছাপার জন্য পাঠিয়েছিলেন।

এইরকম নিষ্ঠাবান লেখকের লেখা পড়াও তাই সৌভাগ্যের। আজকালকার বেশিরভাগ লেখাতেই দেখি বই জুড়ে ঘটনার ঘনঘটা বইয়ে দেওয়ার দুর্দম বাসনা, আর পারলে পাতায় পাতায় প্লট-ট্যুইস্ট দেওয়ার প্রচেষ্টা। এই উপন্যাসটির গল্প বোধহয় চার-পাঁচ লাইনেই বলে দেওয়া যায়, এতই সংক্ষিপ্ত প্লট। অথচ যখন লেখক আস্তে আস্তে মূল চরিত্রটির মনোজগতে ঢোকেন, তার মনের ভয়-আশঙ্কার পরত ধীরে ধীরে উন্মোচন করেন, তখন তথাকথিত অর্থে সেইরকম “প্লট” না থাকলেও স্রেফ লেখার গুণে এই বই ছাড়া যায় না।মূল প্লটটি যেহেতু খুবই স্বল্প, তাই এখানে গল্পের সম্বন্ধে দু-চার লাইন বলাও হয়তো অনুচিত, তাই সেই কাজ থেকে বিরত থাকছি। খালি এইটুকুই বলবো, কেবলমাত্র একটি মূল চরিত্রকে ঘিরে, একটি অতিসংক্ষিপ্ত প্লট নিয়েও যে একটি অসাধারণ উপন্যাস রচনা করা যায়, তা না পড়লে তাও বিশ্বাস হলেও হতে পারে; কিন্তু পড়লে আর কিছুতেই বিশ্বাস হওয়ার জো থাকে না। মতি নন্দীর ছোটগল্পগুলোতেও এই জাদু দেখা যায় , তবে সেই একই জাদু উপন্যাসে দেখানো একটু কঠিন কাজ বই কি।

যাঁরা রসিক পাঠক, যাঁরা তন্ত্র-মন্ত্র, ভূত-দানব, গোয়েন্দা-থ্রিলারের বাইরে মনোস্তাত্ত্বিক উপন্যাস পড়তে চান, তাঁদের জন্য অত্যন্ত সুখপাঠ্য বই।

পুনশ্চঃ আজকাল লেখায় অপশব্দের ব্যবহার নিয়ে নানারকম মত দেখতে পাই। এই উপন্যাসের শুরুর দিকে মতিবাবুও একটি অপশব্দ ব্যবহার করেছেন (এবং আমার একটু চোখে এই কারণেই লাগলো যে, মতিবাবুর অন্য লেখায় আমি চট করে অপশব্দ পাইনি), কিন্তু এই উপন্যাসের এই ঘটনায়, আর বিশেষ শব্দটির প্রয়োগে যেভাবে মূল চরিত্রের মনোগতভাব মাত্র এক-দেড়পাতার মধ্যে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা অসামান্য।


এছাড়াও সকল লেখকদের তালিকা একনজরে দেখুন এখানে

Post a Comment

0 Comments