বই: প্রাণনাথ হৈও তুমি।
লেখক: শ্রী প্রীতম বসু।
প্রকাশকের নাম: প্রীতম বসু, 56, Valleywood Drive, Glenville, New York-12302, USA
মুদ্রণ: দ্য কালার গ্রাফিকস্, কলকাতা।
মূল্য: ৪০০ টাকা।
“প্রীতম বসুর নতুন উপন্যাস বেরিয়েছে বইমেলায়। আমি কিনছি, তোর জন্যে তুলে রাখবো?”
ফোনে বন্ধুর এই প্রশ্ন শুনে “হ্যাঁ” বলতে এক সেকেন্ডও দেরী করিনি। করবোই বা কেন? আমি তো জানিই, প্রীতম বসু মানে কি? ঐতিহাসিক পটভূমিকায় অতীত, বর্তমানের কলাকুশলী সমৃদ্ধ এমন এক সুতীব্র স্রোতস্বিনী রুদ্ধশ্বাস কাহিনী, যা দুর্বারগতিতে পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে চলে এক আশ্চর্য জগতের উদ্দেশ্যে – যেখানে বাস্তব-অবাস্তব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
২০২০-র ডিসেম্বরে সুলেখক শ্রী প্রীতম বসুর তৃতীয় উপন্যাস কপিলাবস্তুর কলস পড়ে ফেলবার পরেই অপেক্ষা শুরু হয়ে গেছিলো তাঁর পরবর্তী উপন্যাসের জন্যে। সৌভাগ্যবশতঃ বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ২০২২-এর মার্চ মাসে কলকাতা বইমেলার শেষদিনে হাতে পেয়ে গেলাম তাঁর চতুর্থ তথা সাম্প্রতিকতম প্রকাশিত উপন্যাস “প্রাণনাথ হৈও তুমি”।
প্রথমেই বলে রাখি, এই কাহিনী শুধু রোমাঞ্চকরই নয়, সেই সঙ্গে বাংলার কীর্তন সংস্কৃতির এক সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ দলিলও বটে। সুর, তাল, ছন্দ সহ কীর্তনের বৈশিষ্ট্যগুলিকে এমন অসামান্য দক্ষতায় লেখক উল্লেখ করেছেন এই কাহিনীতে, যা তাঁর অসীম জ্ঞানপিপাসা ও ঈর্ষনীয় মেধার সুপরিচায়ক।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এম.এ. ক্লাসের গেস্ট লেকচারার প্রবীণ ঐতিহাসিক ডঃ নীতিশ নাগ ওরফে “নাইট্রোজেন”-এর মুখে বর্তমানে অবলুপ্ত সনাতন কীর্তনের উল্লেখ শুনে চমকে ওঠে তাঁর ছাত্র তথা এই কাহিনীর বর্তমান যুগের নায়ক পদাবলী বসু। তার ঠাকুমার নোটবইতে এই কীর্তন লেখা আছে। ঠাকুমার সঙ্গে সনাতন কীর্তন ও তার গায়ক প্রাণনাথ কীর্তনীয়ার কোনোও যোগসূত্র আছে কি না জানতে, নাইট্রোজেনের পরামর্শে সে রওনা দিলো করতালতলী – যেখানে লোককথা অনুযায়ী প্রাণনাথ কীর্তনীয়া না কি রুদ্ধদ্বার নীলমাধবের মন্দিরের মধ্যে থেকে রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে বাইরে প্রতীক্ষারত ব্রিটিশ পুলিশকে ফাঁকি দিয়েছিলো। তারপর থেকেই সে যেমন নিরুদ্দেশ, তাঁর সন্ধানে মন্দিরে প্রবেশ করা ব্রিটিশের পদলেহনকারী অত্যাচারী জমিদার অখিলরঞ্জন সেনও উধাও। কিভাবে তা সম্ভব? মন্দিরে কি রহস্য লুকিয়ে আছে? এর সঙ্গে কি সনাতন কীর্তনের পদের কোনোও সম্পর্ক আছে?
করতালতলীতে যাতায়াত করে সেখানকার মানুষজনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অতীতকে খুঁজে বেড়ায় পদাবলী। শুরু করতে চায় বহু বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া করতালতলীর বিখ্যাত ধূলটমেলা। জমিদারবংশের বর্তমান প্রজন্ম তাকে পদে পদে বাধা দিলেও সে দমে না গিয়ে নিজের অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যায়। তাকে উৎসাহ দেন প্রফেসর নাইট্রোজেন। পাঠকের মনে সন্দেহ জাগে, নাইট্রোজেনের এহেন উৎসাহ কি শুধুই তাঁর ইতিহাসপ্রীতি না তাঁরও কোনোও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য আছে?
শেষ পর্যন্ত কি হবে? প্রাণনাথ কীর্তনীয়া ও জমিদার অখিলরঞ্জনের অন্তর্ধান রহস্যের সূত্র কি সনাতন কীর্তনের ছত্রে ছত্রেই লুকিয়ে আছে? কি কিনারা হবে? পদাবলী কি পারবে ধূলটমেলা আবার চালু করতে?
উত্তর আছে শ্রী প্রীতম বসু রচিত “প্রাণনাথ হৈও তুমি” উপন্যাসে।
পর্যালোচকের রেটিং: ৮/১০
উপন্যাস: প্রাণনাথ হৈও তুমি
লেখক ও প্রকাশক: প্রীতম বসু
প্রচ্ছদ শিল্পী: দেবাশীষ রায়
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২২
পৃষ্ঠা: ৪৩৪
মূল্য: ₹৪০০/-
করতালতলীর প্রাচীন নীলমাধব মন্দিরের নিকট ধুলটডাঙার মাঠে জমিদারমশাইয়ের উদ্যোগে প্রতিবছর তিনদিনব্যাপী বিরাট কীর্তনোৎসব হতো, লোকমুখে যা 'ধুলট' নামে পরিচিত ছিল। শেষ যেবার ধুলট হয় সেবার সনাতন কীর্তন গাইতে গাইতে প্রাণনাথ কীর্তনীয়া নীলমাধবের মূর্তিতে বিলীন হয়ে যান এবং তা প্রায় তিন হাজার ভক্তের সামনে। নীলমাধব মূর্তিতে বিলীন হওয়ার ঘটনা অবশ্য এটাই প্রথম নয়। জনশ্রুতি আছে সনাতন কীর্তনের রচয়িতা স্বয়ং সনাতন গোঁসাইও এই গান গেয়ে নীলমাধবের মূর্তিতে বিলীন হয়েছিলেন।
প্রাণনাথ অন্তর্ধান রহস্যের কারণ যেমন এত বছর পরেও অমীমাংসিত তেমনই অমীমাংসিত সেদিন সনাতন কীর্তনের মহিমা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার পরেও ধুলট কেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। সত্যিই কি প্রাণনাথ বিলীন হয়ে গিয়েছিল নাকি এটা অন্য কোন রহস্য আছে? লেখক তারই জট খুলে উপন্যাসের শেষে।
কীর্তনকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই উপন্যাসে কীর্তন সম্পর্কে যেমন অনেক অজানা তথ্য আছে, তেমনই উল্লেখ আছে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলির কথা, বিপ্লবীদের ওপর অকথ্য, নির্মম অত্যাচারের কথা। বইটিতে স্থান পেয়েছে প্রচুর পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক চরিত্র। উল্লেখ আছে শ্রীরাধিকার প্রবল প্রতিদ্বন্দী চন্দ্রাবলীর কথা। বাংলার কবি জয়দেব, গোবিন্দদাস, চণ্ডীদাস, ঘনশ্যাম কবিরাজ এর কথা এই উপন্যাসে স্থান পেয়েছে।
প্রীতম বসুর রচনাশৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল রহস্যের মোড়কে প্রাচীন বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসকে পাঠকের কাছে তুলে ধরা। "প্রাণনাথ হৈও তুমি" উপন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। এই উপন্যাসে তিনি কীর্তনের পাঁচটি ঘরানা (গরানহাটি, মনোহরসাই, রেনেটি, মন্দারণী ও ঝাড়খণ্ডী)-র সাথে পরিচয় ঘটিয়েছেন। জানা যায় গড়ানহাটি ঘরানার কীর্তনের স্রষ্ঠা হলেন মুঘল বাদশা আকবরের সভাগায়ক তানসেনের গুরুভ্রাতা নরোত্তম ঠাকুর। গল্পে প্রতিটি চরিত্রকেই খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। গল্পের একদম শেষপর্যন্ত উত্তেজনা ধরে রেখেছে এই উপন্যাস তাই আমার কাছে রহস্য উপন্যাস হিসেবে এই উপন্যাস সার্থক। যারা রহস্য গল্প বা উপন্যাস ভালোবাসেন তাঁরা একবার এই বইটা পড়ে দেখতেই পারেন।
আমার রেটিং: ৪.৫/৫
রিভিউটি লিখেছেনঃ Sudip Kr Das
review
বইয়ের নাম - প্রাণনাথ হৈও তুমি লেখক- প্রীতম বসু
"জীবনে মরণে জনমে জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি"
সদ্য শেষ করলাম শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক প্রীতম বসুর লেখা বইটি। সত্যি বলতে কি মুগ্ধ হলাম বইটি পড়ে। পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে বসে ক্রমাগত গুলিয়ে যাচ্ছে কি ধরনের উপন্যাস বলা যায় একে? থ্রিলার ? বাংলা কীর্তনের ইতিহাস নির্ভর ঐতিহাসিক উপন্যাস? ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন নির্ভর কাহিনী ? মিষ্টি মধুর প্রেমের উপন্যাস নাকি রহস্যঘন এক সামাজিক কাহিনী ? সে যাই হোক, বিদগ্ধ লেখকের বহু গবেষণালব্ধ এবং বলিষ্ঠ লেখনী সমৃদ্ধ ৪০০ পাতার এই টান টান উপন্যাসের চরিত্র বিচারের দায়ভার না হয় রইলো আপনাদের উপর ।
এবার আসা যাক গল্পের বিষয়বস্তুতে।
সম্পূর্ণ উপন্যাসটিতে পাশাপাশি চলেছে দুটি কাহিনী। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একটি বর্তমান ও একটি অতীত কাহিনী। কিন্তু মাননীয় লেখকের সুলেখনীর প্রভাবে দুটি কাহিনী এতটাই সম্পৃক্ত যে একবারের জন্যও পৃথক করা যাবেনা কাহিনীদ্বয়কে।
কাহিনীর বর্তমান অংশের নায়ক পদাবলী তার কলেজের প্রফেসর নাইট্রোজেন ওরফে ডঃ নীতিশ নাগের কাছ থেকে সনাতন কীর্তনের বিষয়ে জানতে পারে। সে আরো জানতে পারে যে ৬০ বছর আগে ১৯৩১ সালে করতালতলী গ্রামে ধুলট উৎসবের সময় এক নিখুঁত
পদ্ধতিতে এই সনাতন কীর্তন গেয়ে নীলমাধবের মন্দির থেকে সকলের চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত সশস্ত্র বিপ্লবী প্রাণনাথ বোস । একই জায়গা থেকে অদৃশ্য হন তৎকালীন অত্যাচারী জমিদার অখিলরঞ্জন। আবার এদিকে পদাবলী তার ঠাকুমার পুরানো নোট বইয়ের ভিতর আবিষ্কার করে সেই লুপ্ত হয়ে যাওয়া সনাতন কীর্তনের অংশ বিশেষ ।
করতালতলী গ্রামে গিয়ে পদাবলীর সাথে আলাপ হয় প্রাণনাথ এর সঙ্গী এবং তার অন্তর্ধানের একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী মৃদঙ্গ বাদক ছিলাম বায়েনের। ছিদামের ছেলে গোবিন্দ অধিকারী আপাত কঠিন মনের মানুষ হলেও বাংলার কীর্তনের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু ষড়যন্ত্রের মেঘ ঘনিয়ে আসে। করতালতলীর কীর্তনের ঐতিহ্য শেষ করে দিতে বদ্ধপরিকর হয় স্থানীয় জমিদার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
করতালতলী গ্রামে কি আবার চালু হবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ধুলট উৎসব?, প্রাণনাথ এর রহস্যময় অন্তর্ধানের রহস্য কি ভেদ করতে পারবে পদাবলী ? সে কি জানতে পারবে কি ভাবে তার ঠাকুমার কাছে এসেছিল সনাতন কীর্তন লেখা ওই রহস্যময় নোট বুক অথবা প্রাণনাথ কি শেষ পর্যন্ত বন্ধু মুদঙ্গমের হত্যার প্রতিশোধ নিতে পেরেছিল? প্রফেসর নাইট্রোজেন কিভাবে জানতে পারলেন করতালতলীর এই বিপুল ইতিহাস? তার সাথে করতালতলীর কি সম্পর্ক? পদাবলী কি পারবে প্রফেসর নীতিশ নাগ, গোবিন্দ অধিকারী এবং আরো কয়েকজনের সহযোগীতায় বাংলা কীর্তনের হাত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে? নাকি অত্যাচারী জমিদার অখিলরঞ্জন সেনের যোগ্য উত্তরসূরি তার নাতি চন্দ্রকান্ত সেন এবং চন্দ্রকান্তর পুত্র বদমাইশ মনু সেনের ষড়যন্ত্র জয়ী হবে শেষ পর্যন্ত । হারিয়ে যাবে করতালতলীর কীর্তনের ইতিহাস।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পড়ে ফেলতে পারেন উপন্যাসটি। আর হ্যাঁ, ১০ এর মধ্যে কত নম্বর দেওয়া যায় বলুন তো উপন্যাসটিকে? নাহ, অনেক ভেবে দেখলাম, এই অসাধারণ লেখনীকে নম্বর দেওয়ার মত ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনোটাই এই অধম পাঠকের নেই। সুতরাং এর দায়ভারও বর্তালো আপনাদের উপর।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Jyotirmoy
বইয়ের নাম : প্রাণনাথ হৈও তুমি পার্সোনাল রেটিং- ৮.৫/১০
অদভুত লেখনী প্রীতম বাবুর মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় যে থ্রিলার পড়ছি নাকি কোনও প্রেমের উপন্যাস পড়ছি। ইতিহাস- পদাবলী সাহিত্য- প্রেম-থ্রিলার সবেতেই এমন সুনিপুণ ভাবে বিচরণ করেছেন যে লেখকের গুণমুগ্ধ হয়ে যেতে হয়।
পদাবলী, এক কলেজ ছাত্র কিভাবে জড়িয়ে পড়ে করতালতলীর সুবর্ন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাসের সাথে এবং প্রাণনাথ কীর্তনীয়ার নীলমাধবের মূর্তির মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া গল্পের মূল উপজীব্য। তবে যত গভীরে যাওয়া যায়, প্রবেশ হয় মন্দিরা চরিত্রটির, তার সাথে প্রাননাথের প্রেমের সাক্ষী থাকে পাঠক। উপন্যাস শেষ হয়ে গেলেও মন্দিরা যেন মনের মধ্যে থেকে যায়। কোনও কোনও সময়ে মনে হয় প্রাণনাথ আর মন্দিরার প্রেমই হলো গল্পের প্রধান বিষয়। উপন্যাসটি না পড়লে জানাই যায়না আমাদের বাঙালিদের গৌরবময় পদাবলী সাহিত্যের কথা। এক কথায় থ্রিলার পড়তে পড়তে বাংলার পদাবলী সাহিত্যের অনেক কথাই জানতে পারা যায়, কুর্নিশ জানাই লেখকের এই গবেষণাকে। তবে কোথাও কোথাও গল্পের গতি একটু শ্লথ হয়েছে, অতিরিক্ত পদাবলীর সংযোজনে । একচেটিয়া অর্থোডক্স টাইপের থ্রিলার না হলেও সাসপেন্স নভেল বলাই যায়। গল্পের মূল প্লটের থেকেও তার সাবপ্লট অনেক বেশি উপভোগ্য। পড়ার পর একটা রেশ লেগে থাকে মনের মধ্যে।
" মন্দিরা সন্তর্পনে দরজা খুলল। প্রাণনাথ ধরুটি ঘরের দালান থেকে উঠনে নামল। তারপর একবারও পিছনে না তাকিয়ে খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে অন্ধকারে বনতুলসির ঝোপে হারিয়ে গেল। মন্দিরার বুকের ভিতরে সাশ্রু নয়নে চণ্ডীদাসের রাধা বিড়বিড় করে বলল- জীবনে মরণে জনমে জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি...
রিভিউটি লিখেছেনঃ Jest Das
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।