দীনেশ গুপ্তের রিভলভার
লেখক: সন্মাত্রানন্দ
ধানসিড়ি প্রকাশনা
মূল্য ৫২৫₹
আজ বুঝি একটু থিতু হতে পারলাম। গত শুক্রবার যখন সন্মাত্রানন্দের 'দীনেশ গুপ্তের রিভলভার' শেষ করলাম, কী এক গুরুভার আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমার সমস্ত সত্ত্বাকে। অথচ সে অনুভূতি কোথাও ক্লান্ত করেনা, সমস্তই এক তীব্র সুখানুভব।
দীনেশ গুপ্তের রিভলভারকে হয়ত গ্রন্থাগারিক সাজাবেন সাসপেন্স থ্রীলারের র্যাকে। কিন্তু এ উপন্যাস শুধু থ্রীলারের ঠাসঠাসদ্রুমদ্রামে শুরুও হয়না, শেষও নয়। এই সমস্তর বাইরে আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে যে সুপ্ত বোধ, এক দ্রিমিদ্রিমি তালে সেই বোধকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
এক কিশোরের পাওয়া একটি ড্রয়িংখাতা থেকে শুরু হয়ে এ গল্প পৌঁছে যায় আমাদের মস্তিষ্কের সেইখানে যার আভিধানিক নাম স্যরিয়েল।
মলাটের ধারে, যেখানটাতে গ্রন্থপরিচিতি লেখা থাকে, সেইখানে দালি, শৌনক, পেখম, বিরূঢ়ক এঁদের বলা হয়েছে, উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র। সাথে কিছু গৌণরাও অবশ্যই আছেন। কিন্তু পড়তে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, না শুধু এই হাতেগোনা কয়েকটি নাম নয়, তার বাইরেও এ উপন্যাসের মূল নায়ক হল সময়। বা বলা ভাল একটি যুগ। যুগ চিহ্নিত হয় ঐতিহাসিকের কলমে। কিছু ঘটনা, চরিত্র, তার ব্যাখ্যা এইদিয়েই একটা কাজচালানো গোছের যুগপাঠ আমাদের হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? শুধু এইটুকু পরিসরে বুঝি সময় আঁটানো যায়? আঁটানো যায় সেইসব মানুষ তাদের মানসিকতা আর চিন্তাভাবনাগুলোকে? লেখক এই ট্রেজার হান্টটাই করেছেন সমস্ত উপন্যাস জুড়ে।
এটাই সেই ট্রেজার যা প্রটেক্ট করতে হয় যুগযুগ ধরে। যার আদি মধ্য অন্ত কিছুই নেই।
ইতিহাস নিয়ে কাজ বা লেখা এখন অনেকেই করছেন, তাহলে এই উপন্যাসের বিশিষ্টতা কোথায়? এর স্বকীয়তা হল সেখানেই, এ কোথাও ইতিহাসকে কোথাও একটা কংক্রিট অবয়ব দেবার চেষ্টা করেনা। কোথাও বলেনা, এটাই ধ্রুব। উত্তরকালের হাতে এক ওপেনএন্ডিং বাটন তুলে দিয়ে যায় এ রচন। খানিকটা 'অব তুম্হারে হবালে ইয়ে বতন সাথিয়োঁ'র মত। গল্পের প্রয়োজনে আসা চরিত্রদের মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে ইন্টাররেস্টিং হল, বিরূঢ়কের চরিত্র। 'যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না, আর ' অর্থ নয় কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়- আরও এক বিপন্ন বিষ্ময়, আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে...' মাঝখানের কোন এক জায়গায় তার অবস্থান। বস্তুত অসীম বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে বিরূঢ়ক হলেন সেই অসীম। বাকি চরিত্ররা আমাদের সহনাগরিকই।
আমার ব্যক্তিগত বেশ কিছু জিজ্ঞাসা, প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি এই বইতে। 'সাপ' শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের ভীতির উৎস এবং ব্যপ্তির একটা রূপরেখা বা স্কেচ এঁকেছেন লেখক। একটি আন্দোলন, ইতিহাসের পাতায় তার যাইই নাম হোক আমার কাছে তা শুধুই বারবেরিয়ান বুচারি অব বয়েজ(লিঙ্গভেদ করবেননা প্লিজ, বয়েজ বলতে শুধু ছেলেরা নন), তার যে অন্য কোন ব্যাখ্যাও থাকতে পারে এ উপন্যাস না পড়লে আমার জানা হতনা। সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদ অবশ্যই উসকে দেয় মিনিমালিস্ট কাজের সুচারু ধারণাটি।
পরিশেষে বিশেষভাবে উল্লেখ্য এই বইখানি মোট তিনশ' ছিয়াত্তর পাতার। তার মধ্যে তিনশ' তেষট্টি পাতায় ধরা আখ্যান পেরিয়ে পরিশিষ্টটি অবশ্য পাঠ্য। এ যাবৎকালে লেখার শেষে এমন পরিশিষ্ট আমি পাইনি। যেখানে পরিশিষ্ট (ক) পড়েও এই সংক্রান্ত আরোও বই পড়ার আগ্রহ জন্মাবে। উল্লেখ্য লেখক এখানে কোথাও 'কৈফিয়ৎ' দেবার চেষ্টা করেননি। পরিশিষ্ট (খ) এ কৃতজ্ঞতাস্বীকার পর্বটিও ততটাই মনোগ্রাহি।
আজকের মত এটুকুই। পাঠ শুভ হোক।
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।