দেশনায়কের পথে ।। অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় Desh Nayaker Pothe Review & pdf

দেশনায়কের পথে ।। অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় Desh Nayaker Pothe Review & pdf

দেশনায়কের পথে। 
অনিন্দ‌্য মুখোপাধ‌্যায় 
আনন্দ পাবলিশার্স
মূল‌্য : ৩৫০ টাকা। 
লেখক অনিন্দ‌্য মুখোপাধ‌্যায় একজন স্বঘোষিত ভবঘুরে। কিন্তু লক্ষ‌্যহীন ঘুরে বেড়ানোর বদলে তার উৎসাহ গল্প খোঁজায়, তাই আফ্রিকার মহাদেশের বুক চিরে সাইকেল নিয়ে পাড়ি দেন শঙ্করের পথ ধরে চাঁদের পাহাড়ের উদ্দেশ‌্যে। এবারের অভিযান সিঙ্গাপুর থেকে মণিপুর পর্যন্ত ভারতের শেষ স্বাধীনতার সংগ্রামের পথ ধরে। জানা - অজানা নানা কাহিনী এই বইকে সমৃদ্ধ করেছে। 
১৭ই জানুয়ারি ১৯৪১ সুভাষচন্দ্র দেশ স্বাধীন করার মরিয়া চেষ্টায় ঘর ছাড়েন। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন‌্য অন‌্য ইউরোপীয় শক্তির সাহায‌্য পাওয়ার আশায় পৌছন ইউরোপ, কিন্তু প্রথমে রাশিয়া ও পরে জার্মানী থেকে বিশেষ কোন সাহয‌্যের আশ্বাস না পেয়ে নেতাজি দৃষ্টি ফেরান জাপানের দিকে, জাপানের ' কো - প্রস্পারিটি ' বিদেশনীতি তাঁকে উৎসাহিত করে।  এরই মধ‌্যে ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপান সিঙ্গাপুর দখল করে। সেই খবর ইউরোপে বসে পান নেতাজি  সুভাষচন্দ্র , ঠিক করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই হবে তাঁর কর্মস্থল। তিনি উদগ্রীব হয়ে ওঠেন সিঙ্গাপুর আসার জন‌্য। কিন্তু নেতাজির সিঙ্গাপুর পৌছতে একবছরেরও বেশি সময় লেগে যায়, অবশেষে ১৯৪৩ সালের ২রা জুলাই সিঙ্গাপুর পৌছন নেতাজি। 
জাপানের হাতে বন্দী ব্রিটিশ আর্মির ভারতীয়দের নিয়ে ক‌্যাপ্টেন মোহন সিং এর নেতৃত্বে তৈরী হয় 'ইন্ডিয়ান       ন‌্যাশনাল আর্মি ' বা INA, সেই বছরেই জুন মাসে  ব‌্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে গঠিত কাউন্সিল ফর অ‌্যাকসনে'র চেয়ারম‌্যান হন রাসবিহারী বোস। ঠিক হয় এই কাউন্সিলের নির্দেশেই কাজ করবে INA। কিন্তু বিপ্লবী মোহন সিং গ্রেপ্তার হওয়ায় থমকে যায় INA র কাজ যা আবার গতি পায় নেতাজি সিঙ্গাপুর পৌছলে। 
৪ঠা জুলাই ক‌্যাথে হলের সমাবেশে 'INA এর দায়িত্ব সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দেন রাসবিহারী বোস। পরের দিন পাদাং ময়দানের সমাবেশ থেকে নেতাজী INA এর নামকরণ করেন আজাদ হিন্দ ফৌজ ও লক্ষ‌্য হিসেবে ঘোষনা 'দিল্লী চলো'।  এর তিনমাস পরে ২১ শে অক্টোবর ক‌্যাথে হলেই নেতাজী পড়ে শোনালেন আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্র "। মোটামুটি ডিসেম্বর মাস থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজ মালয় উপদ্বীপ থেকে বার্মার দিকে রওনা হওয়া শুরু হয়। ৭ ই জানুয়ারি১৯৪৪  আজাদ হিন্দ ফৌজের সুপ্রিম কমান্ড সিঙ্গাপুর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে রেঙ্গুনে। সেখান থেকেই ১৮ই মার্চ ১৯৪৪ তার অন্তিম সংগ্রামের পথে রওনা হয়ে মেইকটিলা, পোপা, মনিওয়া, কালেওয়া শহরে একের পর এক যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী কে পরাজিত করতে করতে মণিপুর ও কোহিমা অঞ্চলে প্রবেশ করে আজাদ হিন্দ ফৌজ। কিন্তু বিভিন্ন কারনে ইম্ফল আক্রমণ সফল হয় নি। ১৯৪৪ সালের ১৮ ই জুলাই মণিপুর - কোহিমা সীমান্ত থেকে রিট্রিট ঘোষণা করেন মহম্মদ জামান কিয়ানি। কিন্তু যুদ্ধ এখানেই শেষ হয়নি, ১৯৪৫ এর জানুয়ারি থেকে আবার নতুন উদ‌্যমে আজাদ হিন্দ বাহিনী বার্মার বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ চালায় ব্রিটিশ-আমেরিকা বাহিনীর সাথে। ১৯৪৫সালের ১৫ই আগস্ট জাপান আত্মসমর্পন করার পর আজাদ হিন্দ বাহিনীও আত্মসমর্পন করে। 
নেতাজি ও আজাদ হিন্দ বাহিনী সম্পর্কিত বাড়িঘর  ছড়িয়ে আছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তাইল‌্যান্ড, মায়ানমার ও মণিপুরে। যার কিছু এখনও খুজে বের করতেই লেখকের  এই অভিযান।  সিঙ্গাপুর তার ঐতিহ‌্য রক্ষায় যত্নবান তাই ক‌্যাথে হল এখন মল এ রূপান্তরিত হলেও তার প্রবেশ পথ অপরিবর্তিত রাখা রয়েছে।  মালয় ও তাইল‌্যান্ডে কিছুটা সংরক্ষণ হয়েছে কোথাও স্থানীয় সরকারের চেষ্টায় কোথাও বা প্রবাসী ভারতীয়দের           উদ‌্যোগে। সবথেকে খারাপ অবস্থা মায়ানমারে জুন্টার শাসনে।  অবশ‌্য মায়ানমারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই মণিপুরের মোইরাং আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিস হিসেবে ব‌্যবহৃত বাড়িটি ব‌্যাক্তিগত ভাবে রক্ষিত কিন্তু সরকার রাজপথে নেতাজির মুর্তি বসাতে যতটা উৎসাহী  ততটাই নিরুৎসাহী এই বাড়িটা সংরক্ষনে। দেশ অনুযায়ী লেখক নিজের ভ্রমণপথকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন, সিঙ্গাপুর - মালয়েশিয়া- তাইল‌্যান্ড-মায়ানমার 
বইটার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে নেতাজি সম্বন্ধীয় আবেগ।  লেখকের সঙ্গে আমিও যেন পৌছে যাচ্ছিলাম সেই সব ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে। যেখানে নেতাজির বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হয়ে দলে দলে লোক যোগ দিচ্ছেন বাহিনীতে দান করছেন তাদের সর্বস্ব।  আর্তের সেবায় মেতে উঠছেন সুখী সংসার ফেলে।  সেই আবেগ এখন ছাই চাপা আগুণের মতো এই সব জায়গায় এখনও বিদ‌্যমান।
এই যাত্রায় লেখক দেখা পেয়েছেন কিছু বাল সেনানীর যারা এখন সবায়েরই বয়স আশির উর্দ্ধে,  কোন সুদূর কৈশোরে তারা আজাদ হিন্দ বাহিনীর বাল সেনায় যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু এখনও জয়হিন্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখ চকচক করে ওঠে শিরদাড়া টানটান হয়। নেতাজিকে এনারা দেখেছেন, তাঁর বক্তৃতা শুনেছেন, কেউ কেউ বা হাতও মিলিয়েছেন নেতাজির সঙ্গে। এদের সঙ্গে কথা বলে হাত মিলিয়ে লেখকের শিহরণ আমির অনুভব করি। সবথেকে দুর্দশায় আছেন মায়ানমারে থেকে যাওয়া প্রাক্তন আজাদ হিন্দ সেনানীরা। সেখানকার সরকার তাদের নাগরিকত্ব দেয় নি আর ভারত সরকার তাঁদের খো্ঁজ নেয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রেঙ্গুন সফর কালে তাদের সঙ্গে ছবি তোলায় যে উৎসাহ দেখিয়ে ছিলেন নাগরিকত্ব সংক্রান্ত সমস‌্যা সমাধানে তার তিলমাত্রও দেখাননি।
মূলভূমিতে যখন ভারতীয় জাতিকে ধর্মের নামে ভাঙতে জাতীয় নেতারা তৎপর তখন কি অবলীলায় এতরকমের ধর্মীয় - জাতি গত বিভেদ সরিয়ে শুধুমাত্র স্বাধীনতার মন্ত্রে নেতাজি আজাদ হিন্দ বাহিনীকে ঐক‌্যবদ্ধ করে মরণপন লড়াই চালিয়েছিলেন সেই সব গল্পই এইবইয়ের সম্পদ।  এরকমই একটা গল্প জড়িয়ে আছে ইপোর গুরুদোয়ারা তৈরী নিয়ে, ১৯৪৪ সালের গোড়ার দিকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অষ্টম ডিভিসন ইপোতে তাদের সেনাছাউনি ফেলে। এখানে সৈনিকরা একটা গুরুদোয়ারা তৈরীর প্রস্তাব দেন এদিকে একটা মসজিদ আগে থেকেই ছাউনিতে ছিল কিন্তু কর্নেল মাহতাব সিদ্ধান্ত নেন ছাউনিতে কোন ধর্মস্থানই থাকবে না। তাই গুরুদোয়ারা তৈরী হয় পাশের একটিলার ওপর তাতে হাত লাগান সব শিখ জওয়ানরা, মুসলমান সৈনিকরাও তাদের মসজিদ সরিয়ে নিয়ে যান ছাউনির বাইরে।
দেশের জনগনের সামনে সঠিক আদর্শের অভাব বা সঠিক আদর্শ কে ভুলিয়ে দিতে পারায় শাসক শ্রেণীর     সাফল‌্যই  যে আজ সব দেশের সব হানাহানির মূল। তা এই গল্পগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
বইটির পরিশিষ্টতে যদি আজাদ হিন্দ বাহিনীর টাইমলাইন ও চার্ট করে জায়গাগুলোর গুরুত্ব  সাজিয়ে দিতেন বুঝতে আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের  সুবিধা হত।
পরিশেষে আরেকটি কথা বলার, বর্তমানে নেতাজি নিয়ে আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে থাকে নেতাজির মৃত্যু সংক্রান্ত মিথ। তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনা হয়েছিল কি হয়নি?  তাতে নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল কি হয়নি?  নাহলে ​নেতাজি কোথায় গেলেন?  কেউ কি তাঁকে দেখেছেন? এইসব মিথের পেছনে না ছুটে নেতাজির জানা কীর্তিগুলোয় মনোযোগ দিলে আমরা তাঁকে আরও ভালো জানতে পারব চিনতে পারব।

Post a Comment

0 Comments