নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা
সন্মাত্রানন্দ
দু দিন আগে পড়া শেষ করে এখন থম্ মেরে আছি। ফেবু আর টেলি-তে প্রচুর রিভিউ আর পাঠ প্রতিক্রিয়া দেখে ফেলেছি। নতুন করে সম্ভবত আর কিছু বলার নেই।
শুধু কতগুলো বিষয়ে আমার যা মনে হয়েছে –
১) বাংলা ভাষায় যারা পড়েন (স্কুল কলেজের কথা হচ্ছে না!) – বলছি যারা বাংলা সাহিত্যের প্রেমে এখনও ডুবে আছেন এবং ক্লাসিক্সের সমঝদার, এই বইটি আমার মতে তাদের অবশ্য পাঠ্য।
২) যারা ইতিহাস খুঁজবেন, অতীশ দীপঙ্করের জীবন এবং কার্যকলাপ খুঁজতে চাইবেন, তাদের না পড়লেও চলবে। অন্যান্য অনেক বই আছে যেখানে অনেক বেশি তথ্য সম্বলিত জীবনের কথা লেখা আছে।
৩) যারা অতীশ দীপঙ্করের হলেও হতে পারতো মনের কথা বুঝতে চাইছেন, তারা পড়ুন।
৪) বৌদ্ধ ধর্ম এবং তৎকালীন মঠ জীবনের জীবনদর্শন, আধ্যাত্মচেতনা সম্পর্কে আগ্রহী, তারাও পড়ুন।
৫) ভাষা কঠিন এবং বহু অজানা অচেনা শব্দের মুখোমুখি হতে চাইলে, ভালো বাসলে অবশ্যই পড়বেন।
৬) এই উপন্যাসে অতীশের জীবন এবং দর্শন কোনও একটি বিশেষ সরলরেখা ধরে চলেনি। পাঠক হিসেবে আপনাকে খুব সাবধানে এগোতে হবে, নইলে স্থান এবং কাল সবকিছু গুলিয়ে যেতে পারে।
৭) তিনটি সময় রেখা ধরে অনেক চরিত্র অসংখ্য ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের গতি তরতর করে এগিয়ে এসেছে ইতিহাস থেকে সমকালের।
৮) কিছু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে লেখক তার আধ্যাত্মবাদ সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞান যেন পাঠকের জন্য সুনামির মত করে ঢেলে দিয়েছেন। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা পর্বে। তবে এত সহজ করে উপমার সাহায্যে এর আগে আমি অন্তত এত সুন্দর ভাবে কোথাও পাইনি।
৯) কেমন ছিল একাদশ দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকের জীবনযাত্রা? সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কথা তেমন করে কিছু নেই। তবে মঠ এবং বৌদ্ধ পরিব্রাজক এবং বিদ্ব-সমাজের মানুষের জীবনযাত্রার কিছু কিছু ঝলক আছে।
১০) কল্পবিজ্ঞান ভালো বাসেন? সময় যাত্রা? পোর্টাল ফ্যান্টাসি? আপাতত এখনও পর্যন্ত কোনও রিভিউ বা পাঠ প্রতিক্রিয়াতে এই দৃষ্টিকোণে দেখার কথা আমার চোখে পড়েনি। জানি না ঐ ঐ জনরা গুলো আমার একান্ত পছন্দের বলেই কিনা, তবে এখন, পড়া শেষে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে যে এই উপন্যাসটিকে এই ধারার মধ্যে রাখাই যেতে পারে।
উপন্যাস নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
লেখক সম্মাত্রান
ভারতীয় দর্শনে সামান্য জ্ঞান না থাকলে এই গ্রন্থ আপনার কাছে উপভোগ্য নাও হতে পারে। অথবা যদি আপনার যদি ধৈর্যের অভাব থেকে থাকে তাহলেও এই উপন্যাস আপনার জন্য নয়। অথবা যদি উপন্যাসে আপনি জ্ঞানের কচকচানি সহ্য করতে না পারেন, কেবলমাত্র মূল ঘটনাই আপনার কাঙ্খিত হয়, তাও এই উপন্যাস আপনার জন্য নায়। তাহলে এই উপন্যাস কাদের জন্য যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলি, এই উপন্যাস হলো তাদের জন্য যাদের বিষয়ান্তরের প্রতি ক্ষিদে আছে যাদের প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান পরস্পরায় শ্রদ্ধা আছে, যারা ইতিহাস ভালোবেসে উপন্যাস পড়তে চায় তাদের জন্য। তাই বলি নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা সুখপাঠ্য কোনও হালকা ফুলকা উপন্যাস নয়। আমি এই উপন্যাস পড়ার পরে কেমন যেন ঘোরে আছি বলে মনে হচ্ছে। ইহা নিছক কোনও উপন্যাস নয়, এ যেন এক সময়চক্র বা টাইম- মেশিন। আমার মনকে কেউ যেন কলমের খোঁচায় একাদশ শতক থেকে একবিংশশতকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অকালীক্রমে। এই উপন্যাস পড়া মানে অতীশ দীপঙ্করকে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করা। উপন্যাসের মূল কাহিনীই আবর্তিত হয়েছে বাঙালি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অতীশ দীপঙ্করের জীবনকে। আজকের দিনে অতীশ দীপঙ্করের নামটুকু কোনও রকমে ইতিহাসের পাতায় টিঁকে রয়েছে কিন্তু ওনার মতো এক প্রজ্ঞাবান বৌদ্ধ ভিক্ষু সন্যাসীর বোধহয় আরো সম্মান প্রাপ্য ছিলো। যদিও আমরা আত্মবিস্মৃত বাঙালি কজনকেই বা তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পেরেছি। এই উপন্যাস যতটা ঐতিহাসিক উপন্যাস তার থেকেও অনেক বেশি দার্শনিক উপন্যাস, বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত অজস্র তথ্য সুচারুরুপে প্রকট করেছেন লেখক। আমি তো যথারীতি খাতা পেন নিয়ে বসেছিলাম, বৌদ্ধধর্মের বিষয়গুলো আলাদা করে নোট করার জন্য। এই উপন্যাসের ঘটনা কতটা সত্য কতটা কল্পনাশ্রিত সেই বিষয়ে লেখক কোনও স্পষ্টতা দেখাননি, তাই প্রামাণ্য নিয়ে কথা বলা উচিত হবেনা, তবে লেখকের কল্পনাশ্রিত ঘটনা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভারতের প্রাচীন গৌরবগাথাও এই উপন্যাসে স্থলে স্থলে বর্ণিত হয়েছে। যে বৌদ্ধধর্ম একটা সময়
আভারতবর্ষে দাপিয়ে বেড়িয়েছি, আজ তার অস্তিত্ব কোথায় এই প্রশ্ন আমায় চকিত করে তোলে। বৌদ্ধধর্ম কীভাবে নেপাল থেকে তিব্বতে ছড়িয়ে পড়েছিলো অতীশ দীপঙ্করের হাত ধরে, তা জানার জন্যও এই উপন্যাস অবশ্য পঠনীয়। নেপালের পৈশাচিক বন-ধর্মের হাত থেকে জনমানবের আর্তি ছেদনে সক্ষম হয় এই বৌদ্ধধর্ম।
এই উপন্যাসের ভাষা অত্যন্ত ক্লিষ্ট, স্থানে স্থানে অকস্মাৎ প্রাকৃতিক শোভার অতিবর্ননা প্রকৃত ঘটনার গতিকে অবরুদ্ধ করে। এই একটা বিষয় আমার রুচিতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। অন্যথা, বৌদ্ধদর্শনের বর্ননা ঘটনার প্রবাহ ঘটনার নারীনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সর্বসাকুল্যে আমার মনে হয় ২১-২২ বছর নাহলে এই উপন্যাস না পড়াই শ্রেয়, তাতে কতটা আপনি বুঝতে পারবেন এই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আর উপন্যাসের ঘটনা আমি কোনওদিনই রিভিউর মধ্যে লিখিনা, এটা আমার পোষায় না, এর জন্য আপনাকে উপন্যাস পড়তে হবে, আমি দুঃখিত।
রিভিউটি লিখেছেনঃ রাহল
নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
সন্মাত্রানন্দা
ধানসিডি
জটিল সংখ্যার অঙ্ক যাঁরা করেন, তাঁরা জানেন, ঘোর বাস্তব জগতের কোন রাশির গণনা করার জন্য অনেক সময়ই কাল্পনিক জগতে পেনসিল ছোঁয়াতে হয়। স্বপ্ন আর বাস্তব কল্পনা আর ইতিহাস এগুলো প্রায়শই একটার সঙ্গে একটা এমনভাবে পেঁচিয়ে থাকে যে সেগুলোকে টেনে আলাদা করা কঠিন। বাস্তবজগতের দুটো পাহাড়ের মাঝে যদি নেমে যায় অতলস্পর্শী খাদ, তবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঝাঁপ দিতে স্বপ্নের জগৎ থেকে নেমে আসে এটলাস। ইতিহাস যখন তার সাল তারিখের বোঝা নিয়ে হটিতে ছড়িতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে, তখন তার হাত থেকে রিলে রেসের মশালখানা নিয়ে দৌড় শুরু করে কল্পনা৷ অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে যেতে যেতে সময়ের রাস্তাটা হঠাৎ ইউ টার্ণ নিয়ে চৌমাথার সৃষ্টি করে আর বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামের গরীব কৃষক অনঙ্গ দাস মাটি কোপাতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলে একটা ড্রাগন আঁকা কাঠের বাক্স, যার মধ্যে পাওয়া যাবে একটা তালপাতার পুঁথি, একটা জপমালা আর একটা ধাতুনির্মিত দেবীমূর্তি৷ লীলা মজুমদার ঠিকই বলেছিলেন: সত্যি যে কোথায় শেষ হয় আর স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয় বোঝা ভারী মুশকিলা মুশকিল বলেই বিশ্বাস করতে কাট হয় হাজার বছর আগে যুদ্ধের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া দুই যুযুধান রাজশক্তিকে কি বিচিত্র কৌশলে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করেন অতীশ দীপঙ্করা সেই অতীশ দীপঙ্কর কে তিব্বতে নিয়ে আসার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দেন রাজা লামা এশেও৷ তাঁর অভিপ্রায় পূরণের জন্য ঝঞ্ঝা, বজ্রপাতের মুহূর্তে দুশো বছর আগে নিজ প্রতিরূপের দেহে প্রবিষ্ট হন চাগ্ লোচাবা৷ চতুর্দশ শতকের তিব্বতী ভিক্ষু চাগ লোচাবা কখনও বজ্রডাকিনী স্বয়ংবিদার চুম্বনে প্রক্ষিপ্ত হন একাদশ শতকের বিক্রমশীলায়, কখনো আবার একবিংশ শতকের লেখকের অঙ্গুলিহেলনে গভীর সুপ্তিতে আশ্রয় নেন। রাজকুমার চন্দ্রগর্ভের সঙ্গে বাল্যপ্রীতির মাশুল চোকাতে আত্মবিসর্জন দেওয়ার আগে দৌবারিক কন্যা কুন্তলা উচ্চারণ করে যায় সেই কটা বাক্য:
"যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুদ্ধ বাতাস, নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ
পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে,
আর পালতোলা নৌকা ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতধারায় .....
সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে –
আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালা
তখন কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব...
একাদশ শতকের অতীশ দীপঙ্কর, চতুর্দশ শতকের চাগ লোচাবা, একবিংশ শতকে অমিতায়ুধ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এই গাথার তাৎপর্য অনুভব করবে তাদের সঙ্গে সঙ্গে দেশকালে নানা বিন্দুতে পরিভ্রমণ করতে করতে পাঠকও আবিষ্কার করবেন: কাগজের ওপর বৃক্ষসদৃশ কালো অক্ষরগুলোর মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে লেখকের উষ্ণ আবেগ; সাদা পাতার ওপর পাঠকের মনোজগতের ছায়া পড়ছে এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায় পালতোলা নৌকার মত ভেসে চলেছে গল্প ফুলের পরাগের মত চরিত্ররা ভেসে আসছে গল্পের তোড়ে হঠাৎ করেই পাঠকের চোখ খুলে যাবে আর তিনি একদম নিজের মত করেই দেখবেন সেই নাস্তিক পণ্ডিতের জীবন কে, যিনি ভারতবর্ষ থেকে তিব্বতে গিয়ে তন্ত্রমন্ত্রের কুআচার দূর করার চেষ্টা করেছিলেন তথাগত প্রচারিত ধর্মের দেহ থেকে৷ সে কাহিনীর গলায় জড়ানো কত যুগের, কত দেশের নরনারীর অস্থিনির্মিত মালা৷
রিভিউটি লিখেছেনঃ অতনু
0 Comments
আপনার মতামত লিখুন।